কথায় বলে, ঋণ করে ঘি খাওয়া ভালো না। এর পরিণতি একদিন ভোগ করতে হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই ঘটতে চলেছে। বিগত সরকার আমলে ঢালাওভাবে বাছ বিচার না করেই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বিদেশি ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে। গৃহীত ঋণের একটি বড় অংশই সরকারের সুবিধাভোগিরা আত্মসাৎ করেছে। ফলে উন্নয়ন কাজ থেকে জাতি কাঙ্খিত সুফল পাচ্ছে না। কিন্তু ঋণের কিস্তি ও সুদ ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে। অবস্থা এমন চলতে থাকলে আগামীতে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো আন্তর্জাতিকভাবে ঋণ খেলাপি দেশে পরিণত হতে পারে। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশকে বিদেশি ঋণের সুদ এবং আসল বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছিল ১শ’ ২৯ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে এসে তা ২৬৮ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল বাবদ পরিশোধ করেছে ৪শ’ ০৯ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশ প্রতি মাসে গড়ে ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পরিশোধ করেছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধের
এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৯২০২৩০ অর্থবছরে ৫শ’ ১৫ কোটি মার্কিন ডলার কিস্তি ও আসল বাবদ পরিশোধ করতে হবে। আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুৎ বিগত সরকারের আমলে ১০ বছরে বিদেশি ঋণ গ্রহণের পরিমাণ আড়াই গুন বেড়েছিল। বিগত সরকারে আমলে এমন সব উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বিদেশি ঋণ গ্রহণ করা হয়েছিল জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় যাদের তেমন কোন উপযোগিতা ছিল না। বিতাড়িত আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশকে কার্যত ঋণ নির্ভর একটি দেশে পরিণত করে রেখে গেছে। বর্তমানে যে বিদেশি ঋণ পাওয়া যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে অতীতে গৃহীত ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধের জন্য। ফলে বিদেশি ঋণের মজুত কমে যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের উপর চাপ বাড়ছি।
বিদেশি ঋণের কিস্তি নতুন করে পাওয়া যাক আর না যাক অতীতের ঋণের কিস্তি তো পরিশোধ করতেই হবে। অর্থাৎ ঋণ করে আগের ঋণের সুদ ও মূল কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। ২০২৩ সালের শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৬৪ কোটি মার্কিন ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ১১ লাখ ৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা। এর আগে ২০২২ সালে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের স্থিতি ৯ হাজার ৬৫২ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৪শ’ ১২ কোটি মার্কিন ডলার। গত ডিসেম্বর শেষে জনগণের মাথাপিছু বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫শ’ ৯২ কোটি মার্কিন ডলার সমতুল্য বাংলাদেশি টাকায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাপী ঋণগ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে। গত বছর বৈশ্বিক ঋণ ভাণ্ডারে নতুন করে আরো ১৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার যুক্ত হয়েছে। ফলে মোট বৈশ্বিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩শ’ ১৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর আগে আর কখনোই বৈশ্বিক ঋণের স্তিতি এতটা উচ্চ মাত্রায় পৌঁছেনি। বিদেশি ঋণ গ্রহণ খারাপ কিছু নয় যদি সে ঋণের অর্থ সঠিকভাবে উন্নয়ন কর্মকান্ডে ব্যবহার করে সর্বোত্তম জনকল্যাণ সাধন করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ঋণ গ্রহণের উদ্দেশ্য ছিল যতটা না দেশের উন্নয়ন সাধন করা তার চেয়ে বেশি লক্ষ্য ছিল ঋণের টাকা থেকে কমিশন বাণিজ্য করা। এমন সব প্রকল্পের নামে বিদেশি ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় যার তেমন কোন আবশ্যকতা ছিল না। রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণগ্রহণকালে ৫৫ হাজার কোটি টাকা কমিশন গ্রহণ করেছেন বিতাড়িত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের কতিপয় সদস্য। যদিও তারা এই অভিযোগ মিথ্যে বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু তাদের বক্তব্যের সত্যতা প্রমানে উপযুক্ত কোন প্রমান জাতির সম্মুখে উপস্থাপন করতে পারেননি। কোন কোন প্রকল্পের ফিজিবিলিটি প্রতিবেদনে মুনাফার সম্ভাব্য হার অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে। কর্ণফুলি ট্যানেল নির্মাণকালে আর্থিক আয়-ব্যয়ের যে প্রাক্কলন করা হয়েছিল তা ছিল সম্পূর্ণরূপেই মিথ্যে। বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে এমনই যে, প্রতি দিন এই ট্যানেলের জন্য যে রক্ষনাবেক্ষণ ব্যয় করা হয় উপার্জিত অর্থ দিয়ে তা সংকুলান করা সম্ভব হচ্ছে না। আগামীতে বিদেশি ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে। একই সঙ্গে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জাতির চাহিদা বিবেচনায় রাখতে হবে। উন্নয়ন ব্যয় মেটানোর জন্য অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই।