বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি রোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি পরিণত হয়েছে সারাবছরের এক ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত সোমবারেও ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে ৪১২ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১৮ জনে এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন প্রায় ৩০ হাজার রোগী। এ পরিসংখ্যান নিছক সংখ্যা নয়, বরং প্রতিটি মৃত্যুই একটি পরিবারকে শোকে নিমজ্জিত করছে, প্রতিটি আক্রান্তই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে।

ডেঙ্গুর প্রকোপ যে কমছে না, তা একেবারেই স্পষ্ট। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীসহ সব বিভাগেই আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। বরিশাল বিভাগে সর্বাধিক ১০২ জন আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে ভর্তি হয়েছেন ১২২ জন। গ্রামাঞ্চলেও এ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। অথচ, প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুম ঘিরে ডেঙ্গু মোকাবিলার নামে নানা পরিকল্পনা, প্রচারণা ও সেমিনারের আয়োজন হয়Ñকিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয় না।

বাস্তবতা হলোÑডেঙ্গু মোকাবিলায় সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা এখন নগ্নভাবে প্রকাশিত। এডিস মশার ওষুধ কিনে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়, কিন্তু ওষুধ কতটা কার্যকরÑতা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায়, ওষুধে মশা মরছেই না। বছরের পর বছর ধরে Ñ‘মানুষ সচেতন হচ্ছে না- এ একই দোহাই দেওয়া হয়। অথচ জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্থায়ী কর্মসূচি কোথায়? সংকট দেখা দিলেই সাময়িক প্রচারণা চালানো হয়, এরপর সবকিছু থেমে যায়।

এ ব্যর্থতার দায় এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। নগর কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করার কথা প্রতিদিন শোনা গেলেও মাঠপর্যায়ে তার প্রতিফলন নেই। ওষুধ ছিটানো হয়, কিন্তু তা কতটা কার্যকরÑসে প্রশ্ন থেকেই যায়। জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগও স্থায়ী নয়, বরং সংকট দেখা দিলেই সাময়িক প্রচারণা চালানো হয়। ফলে এডিস মশার বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না।

ডেঙ্গু মোকাবিলায় এখন জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রথমত, এডিস মশার জন্মস্থল চিহ্নিত করে ধ্বংস করতে হবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে। দ্বিতীয়ত, সিটি করপোরেশন ও পৌর কর্তৃপক্ষকে আরও জবাবদিহিমূলকভাবে কাজ করতে হবে। তৃতীয়ত, হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি বাড়াতে হবে যাতে অতিরিক্ত রোগীর চাপে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে না পড়ে। চতুর্থত, জনসচেতনতাকে নিয়মিত ও কার্যকর কর্মসূচিতে রূপান্তর করতে হবেÑযাতে মানুষ ঘরের ভেতরে-বাইরে পানি জমতে না দেয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ডেঙ্গুকে সাময়িক সংকট হিসেবে না দেখে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণ ও অপরিকল্পিত আবাসন সমস্যার কারণে আগামী বছরগুলোতেও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আরও জটিল আকার নিতে পারে। তাই নীতিনির্ধারকদের এখনই কার্যকর ও স্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছে না, বরং প্রতি বছরই নতুন রেকর্ড গড়ে চলেছে। আর দেরি করার সুযোগ নেই। এখনই যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে ডেঙ্গু বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য মহামারির মতো ভয়ংকর হুমকিতে পরিণত হতে পারে। সময় এসেছে কথার ফুলঝুরি নয়, বাস্তব পদক্ষেপের।