ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি বা সীমিত পরিসরের রোগ নয়, বরং এটি দেশের জন্য এক গভীর জনস্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হয়েছে। মঙ্গলবার প্রকাশিত দৈনিক সংগ্রামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মাত্র ২৪ ঘণ্টায় আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ৬৩৬ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৯ হাজারে এবং মৃত্যুর সংখ্যা ১৫৫ জন। এর আগের বছরগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ যে ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল, এ বছরও তার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ২০২৩ সালে যেখানে এক বছরে মারা গিয়েছিলেন ১,৭০৫ জন এবং আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩ লাখ ২১ হাজার মানুষ, ২০২৪ সালেও আক্রান্ত হয়েছিল এক লাখের বেশি মানুষ এবং মারা গিয়েছিলেন ৫৭৫ জন। এসব পরিসংখ্যান শুধু আতঙ্ক বাড়ায় না, বরং নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতাও স্পষ্ট করে তুলে ধরে।
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ প্রতি বছরই আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে এক বছরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং মারা গিয়েছিলেন ১,৭০৫ জন। ২০২৪ সালেও আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কম ছিল না। এ ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারছে না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নগর ব্যবস্থাপনার ঘাটতি, নালা-নর্দমা পরিষ্কার না থাকা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা এবং সঠিক সময়ে কীটনাশক ছিটানোর অনিয়ম বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হলো মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করা। অথচ নগর কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগ এখনও মূলত দায়সারা। বর্ষাকালে মশা নিয়ন্ত্রণে সাময়িক প্রচারণা চালানো হলেও সারা বছরব্যাপী পরিকল্পিত কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই। অন্যদিকে, হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বাড়লেও চিকিৎসা ও সেবার মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে প্রয়োজন একটি সমন্বিত জাতীয় উদ্যোগ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশন ও জনসাধারণকে নিয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। নগর পরিকল্পনায় স্থায়ীভাবে পানি জমে থাকার জায়গা কমানো, নিয়মিত নালা-ড্রেন পরিষ্কার রাখা, স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে অফিস-আদালত পর্যন্ত সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করা অপরিহার্য। একইসঙ্গে হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড, আইভি স্যালাইন, ওষুধ এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিশ্চিত করতে হবে। সচেতনতা কার্যক্রমে শুধু প্রচারণা নয়, আইন প্রয়োগেরও প্রয়োজন আছে। অনেক দেশেই ডেঙ্গু প্রতিরোধে বাড়ির ছাদে বা আঙিনায় পানি জমে থাকলে অর্থদ-ের ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশেও এমন আইনি কাঠামো সক্রিয়ভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে। তাছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তিনির্ভর সমাধানÑ যেমন বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল, ড্রোন ব্যবহার করে দূরবর্তী জায়গায় স্প্রে, কিংবা জেনেটিকালি পরিবর্তিত মশার প্রয়োগÑ এসব বিষয়ে গবেষণা ও প্রয়োগে বিনিয়োগ করতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু কেবল একটি স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়; এটি অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনের ওপরও বিরাট প্রভাব ফেলে। প্রতিটি পরিবারের চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, কর্মক্ষম মানুষ হারাচ্ছে জীবন। এ মানবিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি ঠেকাতে এখনই বাস্তবমুখী এবং কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সময়ক্ষেপণ মানে আরও মৃত্যু, আরও বিপর্যয়। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা চাই, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো দায়সারা মনোভাব পরিহার করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই ও বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ নেবে। অন্যথায় প্রতি বছরই একই শোকে নিমজ্জিত হতে হবে আমাদের।