ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সহকারী প্রক্টর শেহরীন আমিন ভূঁইয়া মোনামির ছবি বিকৃত করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করার ঘটনাটি বাংলাদেশের সমাজে নারী নিরাপত্তা ও ডিজিটাল নৈতিকতার গভীর সংকটকে সামনে এনে দিয়েছে। একজন সম্মানিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ব্যক্তিগত ছবি বিকৃত করে প্রকাশ করা, তার চরিত্র নিয়ে কুৎসা রটানো এবং তা হাজার হাজার মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে সমাজের এক উদ্বেগজনক নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র ফুটে উঠেছে। মোনামি নিজেই যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসকক্ষে বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব বিকৃত পোস্ট দেখেন, তখন তার মানসিক অবস্থার কী হয়েছিল-তা সহজেই অনুমেয়। এরই মধ্যে এ ঘটনায় ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মামলাটির তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন, যা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে সাইবার বুলিংয়ের এমন অগণিত ঘটনা ঘটে চলেছে, যার অধিকাংশই ন্যায়বিচারের মুখ দেখে না। অভিযোগ দায়েরের পরও অনেক সময় আইনি প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়, অপরাধীরা পার পেয়ে যায়, আর ভুক্তভোগীরা সামাজিকভাবে আরও নিপীড়নের শিকার হন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকলেও, তার কার্যকর প্রয়োগের অভাবই এখন বড় প্রশ্ন।

আজকের বাস্তবতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন দ্রুত সংবাদ, মতামত ও তথ্য বিনিময়ের শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম, তেমনি এটি এখন ঘৃণা, বিদ্বেষ, অপমান ও চরিত্রহননের এক ভয়াবহ মঞ্চেও পরিণত হয়েছে। একজন নারী যখন কোনো সামাজিক বা পেশাগত কারণে আলোচনায় আসেন, তখনই তার বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্য, বিকৃত ছবি, মিথ্যা গুজবÑএসব যেন নিয়মে পরিণত হয়। এটি কেবল নারী বিদ্বেষের প্রকাশ নয়, বরং আমাদের মানসিকতার গভীরে প্রোথিত অসুস্থতা ও বিকৃত সংস্কৃতির প্রতিফলন। শিক্ষিকা মোনামির বিরুদ্ধে এ অপপ্রচার ও নেতিবাচক কর্মকান্ড প্রকাশ্যে আসে ডাকসু নির্বাচনের সময় থেকে। তার বিরুদ্ধে ক্ষোভের কারণ ছিল এই যে, তিনি নির্বাচনে দল মত নির্বিশেষে সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু নেপথ্য কারণ যা’হোক-এ ধরনের ঘটনা মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত সমাজে যখন একজন শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা করা যায় না, তখন সাধারণ নারীরা কীভাবে নিরাপদ থাকবেন, সে প্রশ্ন সমাজের প্রতিটি স্তরকে নাড়া দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞান, গবেষণা ও নৈতিকতার কেন্দ্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের প্রতি এমন আক্রমণ গোটা শিক্ষা পরিবেশকেই কলঙ্কিত করে। এটি শুধু একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, বরং শিক্ষাক্ষেত্রের সম্মান, পেশাগত মর্যাদা এবং নারীসমাজের মর্যাদার ওপর আঘাত।

পেশাজীবী মহিলা ফোরাম এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং সকল নারী-পুরুষকে সাইবার বুলিং ও স্লাট শেমিংয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এ আহ্বান কেবল নারীদের জন্য নয়; এটি আমাদের সবার জন্য। কারণ সমাজ তখনই সুস্থ হয়, যখন সেখানে সম্মান, সহনশীলতা ও মানবিকতা সবার জন্য সমানভাবে নিশ্চিত হয়। এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও পরিষ্কার হলো, শুধু আইন থাকলেই হবে নাÑপ্রয়োগে কার্যকারিতা, তদন্তে দক্ষতা, এবং বিচার প্রক্রিয়ায় গতি থাকতে হবে। এর পাশাপাশি প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা ও শিক্ষার প্রসার। পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্তÑসর্বত্র নারীকে সম্মান করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। ডিজিটাল নৈতিকতা এখন শিক্ষার একটি অপরিহার্য অংশ হওয়া উচিত।

আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যে অংশটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়, তাদের সচেতন করা এখন সময়ের দাবি। তাদের বোঝাতে হবে-কাউকে অপমান করা বা ছবি বিকৃত করে প্রচার করা কোনো “বিনোদন” নয়; এটি একটি অপরাধ, যা আইনের চোখে দণ্ডনীয়।

শেষ পর্যন্ত, শেহরীন আমিন ভূঁইয়া মোনামির ঘটনা আমাদের সামনে একটি আয়না ধরেছেÑআমরা কীভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার করছি, কীভাবে আমাদের নৈতিক মানদণ্ড হারিয়ে ফেলছি, এবং কীভাবে নারীকে এখনো সামাজিকভাবে সমান মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। এ আয়নায় নিজেদের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সময় এখনই। একজন নারীর মর্যাদার প্রতি আঘাত মানে গোটা সমাজের নৈতিক পরাজয়। তাই এ ঘটনার নিন্দা জানানোই যথেষ্ট নয়Ñপ্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ, সচেতন সমাজ ও দৃঢ় আইনি কাঠামো। নইলে সাইবার বুলিংয়ের এ আগ্রাসন শুধু নারীদের নয়, পুরো সমাজকেই ধীরে ধীরে অন্ধকারে ঠেলে দেবে।