ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশ (আইসিসিবি) এর উদ্যোগে গত ১৪ আগস্ট রাজধানীতে আয়োজিত, ‘এলডিসি গ্রাজুয়েশন: সাম অপশনস ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক সেমিনারে দেশের শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তা-ব্যবসায়িগণ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তরণের সময় সীমা ৩ থেকে ৫ বছর বৃদ্ধি করার জন্য অনুরোধ করেছেন। তারা বলেছেন, এ মুহূর্তে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার সিদ্ধান্ত হবে মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত এবং এধরনের সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতি করে হতে পারে। উল্লেখ্য,পরিকল্পনা মোতাবেক আগামী বছর (২০২৬) বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবে। বিগত সরকার আমলে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য তুলে ধরার চেষ্টা করা হতো। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন, উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার সময় সম্ভবত বাড়ানো হবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের পরিকল্পনা মতই ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে।

এর আগেও একাধিক ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার সময় সীমা অন্তত ১০ বছর পিছিয়ে দেবার অনুরোধ করেছিলেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বাংলাদেশ এখনো উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার মতো সামর্থ্য অর্জন করতে পারেনি। তাই এ মুহূর্তে যদি উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তা হবে একটি ভুল সিদ্ধান্ত। শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার পর আবারো স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় নামিয়ে দেয়া হতে পারে। গত ৫০ বছরে অন্তত ৭টি দেশকে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার পর আবারো স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় নামিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে তার ভালোমন্দ যাচাই করা প্রয়োজন।

উল্লেখ্য, নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দল (বিএনপি) ক্ষমতায় থাকাকালে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার শোনা গিয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান সে আহ্বানে সাড়া দেননি। বাংলাদেশ যদি উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হয় তাহলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা হারাবে। বর্তমানে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশের কাছ থেকে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টের অব প্রেফারেন্স) পেয়ে থাকে। উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার পর বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা হারাবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা দিয়ে আসছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন হচ্ছে বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের সর্ববৃহৎ গন্তব্য। আলোচনা সভায় একজন ব্যবসায়ী নেতা বলেন, বাংলাদেশ যদি এ মুহূর্তে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হয় তাহলে জিএসপি সহ অন্যান্য শুল্ক সুবিধা হারালে প্রতি বছর গড়ে ৬ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশ রপ্তানি আয় হ্রাস পাবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদিও বলেছে, বাংলাদেশ ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হলেও তারা ২০২৯ সাল পর্যন্ত জিএসপি সুবিধা বহাল রাখবে।

তারপর জিএসপি+ নামে এক নতুন শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করা হবে। কিন্তু জিএসপি+ সুবিধা পেতে হলে যেসব শর্ত পরিপালন করতে হবে বাংলাদেশের পক্ষে তা সম্ভব হবে না। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন অনুষ্ঠানে বলেন,এলডিসি’র জন্য বাংলাদেশ যতটা না অর্থনৈতিক বিবেচনায় এগিয়েছে তার চেয়ে বেশি ছিল রাজনৈতিক কারণ। উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার ক্ষেত্রে আবেগ নয় বিবেককে কাজে লাগাতে হবে। উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার পর আবারো স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে নেমে আসার মতো লজ্জাজনক অবস্থায় পড়ার চেয়ে এ ব্যাপারে আরো ‘ধীরে চলো’ নীতি গ্রহণ করাই যুক্তিসঙ্গত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে রপ্তানি পণ্যের উপর বর্ধিত হারে অতিরিক্ত শুল্কারোপের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের অবস্থা কেমন হয় সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন।