আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,

  • চুনি উঠল রাঙা হয়ে।

আমি চোখ মেললুম আকাশে-

  • জ¦লে উঠল আলো
  • পুবে পশ্চিমে।

গোলাপের দিতে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর’Ñ

  • সুন্দর হল সে।

সে কতকাল আগে কবি তার কথা বলেছেন। কবির কথায় দর্শন থাকে, তত্ত্ব থাকে, থাকে সৌন্দর্যতত্ত্বওÑ যাকে বলা হয় নন্দন তত্ত্ব। কবি যখন লেখেন, তখন একটা বিশেষ পরিবেশ থাকে, সময় থাকে এবং থাকে কবির বিশেষ উপলব্ধিও। কবি যখন শান্তিনিকেতনের পরিবেশে ‘আমি’ কবিতাটি লেখেন, তখন সময়টা ছিল ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৩ সাল। আর আজ আমি যখন ওই কবিতাটি চর্চা করছি, তখন সময়টা ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২ সাল। সময়ের হিসেবে ৮৯ বছরের ব্যবধান। ৮৯ বছর আগে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে চেতনায় কথা বলেছেন, ‘সুন্দরের’ সাথে ‘আমির’ যে সম্পর্ক ঘটিয়েছেন, তা কি বর্তমান সময়েও প্রবাহমান থাকতো? এতগুলো বছর পরেও? ‘আমি’ সত্তা কি সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়ে যায়? না কি একই থাকে? ৮৯ বছর আগে ‘আমি’ কবিতার পাঠক ছিল, পাঠক এখনও আছে। তবে প্রশ্ন হলো, সব যুগের পাঠকের উপলব্ধি ও বিশ্লেষণ কি একই রকম হবে? সবাই কি এ রকম ভাববেনÑআমি সুন্দর হলেই গোলাপ সুন্দর হবে, কিংবা আমার চোখে আলো থাকলেই আকাশে আলো জ¦লবে? অর্থাৎ বিশ্বচরাচরে ‘আমিটাই’ আসল? সবাই তো এ রকম নাও ভাবতে পারে। ভিন্ন ভাবনা, বিকৃত ভাবনার সম্ভাবনাও আছে। বর্তমান সভ্যতায় তো বিকৃত ভাবনার আধিক্যই লক্ষ্য করা যাচ্ছেÑসেটা সাহিত্য ভাবনা হোক, রাজনৈতিক ভাবনা হোক কিংবা ব্যবসা-ভাবনা। আর এখানে ভূরাজনীতির কথা না বলাই ভালো। বললে সভ্যতার আর ইজ্জত থাকবে না। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, ইউক্রেনে যা হলো এবং গাজায় যা হচ্ছেÑতা কি বিকৃত ভূরাজনীতির নিকৃষ্ট উদাহরণ নয়? সংস্কৃতি ও শোবিজ জগতের চিত্রও আলাদা কিছু নয়। এসব অনাচার ও বিকৃতির পেছনে তো আছে বিশাল কর্মযজ্ঞ, কর্মযজ্ঞে তো যুক্ত থাকে বহু মানুষ, মেধা ও যোগ্যতায় তারা বেশ প্রোডাক্টিভও বটে। কিন্তু তাদের এমন প্রোডাক্টিভিটির ফলটা কেমন হলো পৃথিবীর মানুষের জন্য? রবীন্দ্রনাথের ‘আমি’র যে প্রোডাক্টিভিটি, তার সাথে পাশ্চাত্য সভ্যতার বর্তমান যে প্রোডাক্টিভিটি, তার মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় কী?

বর্তমান সভ্যতায় শুধু ‘যুদ্ধ’ ও ‘বিকৃতিকে’ প্রশ্ন করলে হবে না, আসল প্রশ্নটা করতে হবে ‘মানুষকে’। এ মানুষ কেমন মানুষ, এ মানুষের ভেতর যে ‘আমি’ আছে, সেটা কেমন ‘আমি’? এ আমিকে তো আমরা ‘কলব’ বলি, ‘হৃদয়’ বলি। জুলুম ও পাপ করতে করতে কি মানুষের হৃদয়টা পাথর হয়ে গেছে? ওদের বোধ হয় মানবিক উপলব্ধির কোনো সামর্থ্য নেই। নয়তো গাজা এমন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় কেমন করে? এসব ধ্বংসযজ্ঞের নেতৃত্বে তো সভ্যতার শাসকরাই আছেন। ফলে প্রশ্ন জাগে, এ কেমন সভ্যতা? এ সভ্যতার মূলে রয়েছে তিনটি বিষয়। ১. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চার মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং ত্রুটি ও ঘাটতি চিহ্নিত করে অধিকতর উদ্যোগ। ২. ‘পারসুট অব ম্যাটেরিয়ালিজম’, শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে টাকার পেছনে ছোটার চিত্রে এ বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়। এ লক্ষ্যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে আরও প্রোডাক্টিভ তথা আরো কর্মক্ষম হওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। ফলে মানুষ এখন যন্ত্রে পরিণত হয়েছে এবং মানুষের জায়গা দখল করে নিচ্ছে যন্ত্র, ‘এআই’ যার বড় উদাহরণ। ৩. ধর্মবিমুখতা। চার্চ ও রাষ্ট্র আলাদা হওয়ার পর থেকেই পাশ্চাত্যের মানুষ ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। ফলে তারা উৎপাদন ও অর্থের পেছনে বেশি সময় দেওয়ার সুযোগ পায়। এর ফলাফলটা কেমন হলো?

পাশ্চাত্যের মানুষ এখন যে জীবন দর্শনে গতিময়, এক কথায় তাকে আমরা ‘সেুকলারিজম’ বা ইহলৌকিকবাদিতা হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। ধর্মবিমুখ এ মতবাদের অনুসারী হিসেবে পাশ্চাত্যের মানুষ বেশ Productive বা উৎপাদনশীল হয়ে উঠেছে। তাদের Productive বা উৎপাদনক্ষমতাও দেখার মতো। তবে আপাতমুগ্ধভাব সরে গেলে আমরা যদি গভীর পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে বিবেচনা করি, তাহলে হয়তো রবীন্দ্রনাথের মতো আমরাও বলবো, ‘মানবপীড়নের মহামারি পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর থেকে জাগ্রত হয়ে ওঠে আজ মানবাত্মার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বাতাস কলুষিত করে দিয়েছে।’ জীবনের শেষের দিকে আশি বছর পূর্তি উপলক্ষে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটি পঠিত হয়। ওই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ আও বলেন, ‘পাশ্চাত্য জাতির সভ্যতা-অভিমানের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা অসাধ্য হয়েছে। সে তার শক্তিরূপ আমাদের দেখিয়েছে, মুক্তিরূপ দেখাতে পারেনি। অর্থাৎ মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ সবচেয়ে মূল্যবান এবং যাকে যথার্থ সভ্যতা বলা যেতে পারে তার কৃপণতা এই ভারতীয়দের উন্নতির পথ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে দিয়েছে।’ তরুণ বয়সে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি রবীন্দ্রনাথেরও একটা মুগ্ধভাব ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সে মুগ্ধভাব কেটে গেছে। জ্ঞান ও অভিজ্ঞানের সে কথা স্পষ্ট হয়েছে তার ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে। পাশ্চাত্য আসলেই বিশ্ববাসীকে তার ‘শক্তিরূপ’ দেখিয়ে যাচ্ছে, ‘মুক্তিরূপ’ দেখাবার সামর্থ্য তার নেই। তার বড় উদাহরণ গাজা-ট্যাজেডি। পাশ্চাত্যের যে প্রোডাক্টিভিটি, তা মানবজাতিকে কী উপহার দিল? আস্থার সঙ্কট, মারণাস্ত্র প্রতিযোগিতা, যুদ্ধবিগ্রহ, অর্থনৈতিক সংকট, বৈষম্য, বর্ণবাদ, জলবায়ু দূষণ, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি, অর্থাৎ পৃথিবীটাকে মানুষের বসবাসের অনুপযোগী করার জন্য যা যা করা দরকার, তার সবই করেছে পাশ্চাত্য সভ্যতা। আর তা নিয়ে দম্ভ করছেন পাশ্চাত্যের হৃদয়হীন মাথামোটা নেতারা। ফলে এখন মানবমনে প্রশ্ন, পাশ্চাত্যের এ প্রোডাক্টিভিটি দিয়ে মানবজাতি কী করবে? যে উৎপাদনশীলতা মানুষকে ভয় দেখায়, কিন্তু মুক্তির পথ দেখায় নাÑ সেই উৎপাদনশীলতা মানুষের কাম্য হতে পারে না।

এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে প্রোডাক্টিভিটির কি কোনো প্রয়োজন নেই? মানবসম্মত প্রোডাক্টিভিটির প্রয়োজনীয়তা অতীতে ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। তাহলে বর্তমানে থাকবে না কেন? বিবেচনার বিষয় হলো, পাশ্চাত্যের প্রোডাক্টিভিটি কেন মানুষের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠলো? এর স্বরূপ জানতে হলে পাশ্চাত্যের প্রোডাক্টিভিটির ভিত্তিগুলো আমাদের পরখ করে দেখতে হবে। এখানে যুক্ত ছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চা, যুক্ত ছিল ‘পারসুট অব ম্যাটেরিয়ালিজম’Ñ শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে যা মানুষকে টাকার পেছনে গড্ডলিকা প্রবাহের মতো ছুটতে সাহায্য করেছে। আর সবচাইতে মারাত্মক বিষয় ছিল, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। ইউরোপীয় রেনেসাঁর নেতাদের রাগ ছিল ধর্মযাজকদের ওপর। তারা শাসকের অন্যায়ের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু রেনেসাঁর নেতারা এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, ধর্মযাজকের ভুলের জন্য ধর্ম দায়ী নয়। ধর্মযাজকদের অন্যায়ের দায় ধর্মগ্রন্থের ওপর বর্তাবে কেন? এখানে প্রতিক্রিয়াশীলতার পরিবর্তে প্রয়োজন ছিল পরিচ্ছন্নতা, কারেকশনের। যে অপরাধ ধর্ম করেনি, সে অপরাধের শাস্তি দেওয়া হলো ধর্মকে। সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বহিষ্কার করা হলো। এখানে সংকট হলো, সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাস করতে হলে যে যার মতো চলতে পারে না। এখানে নিয়ম-নীতি, আইন-কানুন ও শৃঙ্খলা প্রয়োজন এবং প্রয়োজন নেতা।

এগুলো কিভাবে ঠিক হবে, কে ঠিক করবে? অভিজ্ঞতায় লক্ষ্য করা গেছে, মানুষ এগুলোর সব নিজে ঠিক করতে গেলে বর্ণ, ভাষা, গোত্র, গোষ্ঠীর কারণে ইনসাফপূর্ণ আচরণ প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। তাই যুগে যুগে মহান স্রষ্টা মানুষকে পথ প্রদর্শনের জন্য, ইনসাফপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন নবী-রাসূলদের। মূসা নবীর অনুসারীদের বলা হয় বনি-ইসরাইল বা ইহুদি। ঈসা নবীর অনুসারীদের বলা হয় নাসারা বা খৃস্টান, মোহাম্মদ (সা.)-এর অনুসারীদের বলা হয় মুসলিম। তবে এখানে একটি প্রশ্ন আসতে পারে, ওই সব ধর্মে বিশ্বাসীরা কি নবী-রাসূলদের এখন মানছেন কিংবা ধর্মের বিধিবিধানের আলোকে জীবনযাপন করছেন, আর করলে কতটা করছেন করছেন না বলেই তো আজ পৃথিবীতে যত সংকট। মহান প্রভুকে ভুলে ক্ষমতাসীনরা এখন ছোট ছোট প্রভু হয়ে উঠেছেন। নিজেরাই বিধান তৈরি করে নিজেদের মতো করে পৃথিবীটাকে চালাতে চাইছেন। কারো সাথে কারো মিলছে না।

ফলে চলছে ভূ-রাজনীতি। এতে বিশ্বে সৃষ্টি হয়েছে আস্থার সংকট। এ সংকট মোকাবেলায় একদিকে চলছে কূটনৈতিক চাতুর্য, অপরদিকে মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা। এখানে আবার আছে বর্ণবাদ, সবাই সব অস্ত্র তৈরি করতে পারবে না, পারমাণবিক অস্ত্র শুধু অভিজাতদের জন্য। আন্তর্জাতিক আইনেও আছে রকমফের। অভিজাতদের জন্য আইন একরকম, অন্যদের জন্য ভিন্ন। এমন এক বৈষম্যমূলক ও ন্যায়নীতিহীন সভ্যতায় এখন মানুষের বসবাস। এমন সভ্যতা আসলে মানসম্মত মানবসভ্যতা নয়। কাক্সিক্ষত মানবসভ্যতা পেতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে মহান স্রষ্টা প্রেরিত ধর্মদর্শনে। এর অভাবেই এখন পাশ্চাত্যে যে প্রোডাক্টিভিটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে বিশ্বে বৈষম্য ও ভীতির ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় পাশ্চাত্য তার ‘শক্তিরূপ’ আমাদের দেখিয়েছে, ‘মুক্তিরূপ’ দেখাতে পারেনি। তাহলে মানবমুক্তির জন্য আমরা কোন পথে চলবো? আমরা কি প্রোডাক্টিভিটিকে অবজ্ঞা করবো? না ধর্ম কখনো এমন কথা বলেনি। আমরা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চর্চা করবো, উৎপাদনশীলতা বাড়াবো, সবাইকে নিয়ে বাঁচার চেতনায় অর্থের গোলাম না হয়ে বরং বণ্টন ব্যবস্থায় ইনসাফ আনবো। বৈষম্য ও বর্ণবাদের বদলে আমরা সবাই স্রষ্টার বান্দা হবো। আখিরাতে জবাবদিহিতার চেতনায় আস্থা রাখবো। পুনঃপাঠ করবো হযরত মূসা (আ.), ঈসা (আ.) এবং মোহাম্মদ (সা.)-এর সোনালি হরফগুলো।