কক্সবাজারে আয়োজিত তিন দিনের আন্তর্জাতিক সংলাপ “স্টেকহোল্ডার্স’ ডায়ালগ: টেকঅ্যাওয়ে টু দ্য হাই-লেভেল কনফারেন্স অন দ্য রোহিঙ্গা সিচুয়েশন”-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সাত দফা প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছেন। প্রস্তাবনাগুলো কেবল বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর নয়, বরং সমগ্র মানবতার পক্ষে এক সুসংগঠিত রূপরেখা। গত আট বছরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরের ভার বহন করেও বাংলাদেশ মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে এসেছে। তবে এ সংকটের স্থায়ী সমাধান বাংলাদেশে নয়, মিয়ানমারে নিহিত-এ কথাটিই ইউনূস তাঁর প্রস্তাবে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।

অধ্যাপক ইউনূসের প্রস্তাবনার মূল দিকগুলো হলো: দ্রুত, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রণয়ন; আন্তর্জাতিক দাতাদের অব্যাহত সমর্থন; মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মির কাছে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও জীবিকা নিশ্চিতকরণ; রোহিঙ্গাদের সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপ ও অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা; আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা; গণহত্যার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক আদালতে জবাবদিহিতা ত্বরান্বিত করা। এ সাত দফা একদিকে যেমন সংকট সমাধানের রূপরেখা দিয়েছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও একটি করণীয় তালিকা তৈরি করেছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৩ লাখ। প্রতি বছর প্রায় ৩২ হাজার নতুন শিশু জন্ম নিচ্ছে শরণার্থী শিবিরে। সীমিত সম্পদ নিয়েও বাংলাদেশ ও কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণ গত আট বছরে যে বিশাল মানবিক দায়িত্ব পালন করেছেন, তা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। কিন্তু এ দীর্ঘস্থায়ী ভার বহন করা আর সম্ভব নয়। স্থানীয় জনগণের সামাজিক-অর্থনৈতিক চাপ, পরিবেশগত ক্ষতি এবং নিরাপত্তাজনিত হুমকি ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। সুতরাং বৈশ্বিক সহযোগিতা ছাড়া এ সংকটের কোনো সমাধান নেই। সীমিত সম্পদ নিয়েও কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণ যে অসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তা প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এ ভার বহন করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে।

রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশের নয়-এটি বৈশ্বিক দায়িত্ব। সুতরাং দাতাদের অর্থায়ন ঘাটতি পূরণ করা, মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখা এবং মিয়ানমারের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব। শুধু বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ থেকে নয়, বরং কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েই বিশ্বকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা গণহত্যা ও জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে।

রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ অবস্থানও ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি, জাতীয় নাগরিক পার্টি, এবি পার্টি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা এ সংলাপে অংশ নিয়ে একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের একক সংকট নয়, এটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যা। ফলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া সমাধান অসম্ভব। আজকের এ বাস্তবতায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করা। আসিয়ান ও প্রতিবেশী দেশগুলোকে রাখাইনে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য উদ্যোগী হতে হবে। একই সঙ্গে মানবপাচার, মাদক ও ক্ষুদ্র অস্ত্রের অবৈধ ব্যবসার মতো আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমন করাও জরুরি।

অধ্যাপক ইউনূসের এ প্রস্তাব কেবল একটি জাতির টিকে থাকার লড়াই নয়, বরং বৈশ্বিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠারও আহ্বান। রোহিঙ্গাদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া, মিয়ানমারের দায়ীদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা এবং নিরাপদে মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করাই হবে মানবতার প্রকৃত বিজয়। এখন আর নতুন কোনো প্রতিশ্রুতি নয়, প্রয়োজন বাস্তবায়ন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত অবিলম্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে এগিয়ে আসা। বাংলাদেশ তার দায়িত্ব পালন করেছে, এবার বিশ্বকে দায়িত্ব নিতে হবে।