প্রকৃতিতে বৈচিত্র্য আছে, বাগানের সব ফুল এক রকম হয় না। গঠন কাঠামোয়, রঙে, সুবাসে ফুলগুলো আলাদা আলাদা। আপন আপন বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত থাকার পরেও ফুলগুলো এক সাথে থাকে। দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় না, পরস্পরকে দোষারোপও করে না। বৈচিত্র্যের এ যে ঐক্য, এ কারণেই ফুলের বাগান আমাদের কাছে এত প্রিয়। বিনোদনের প্রয়োজনে এবং মানসিক কষ্ট লাঘবে আমরা অনেকেই বাগানের মনোহর পরিবেশে গিয়ে থাকি। বিষয়টি চিন্তাশীল মানুষকে প্রেরণা দেয়। তারা বাগানের বৈচিত্র্যের ঐক্যকে মানবসমাজেও প্রতিষ্ঠা করতে চান। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সে উদ্যোগ লক্ষ্য করা গেছে, লক্ষ্য করা গেছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও। ভারতের সংবিধানেও ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ দর্শনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

ভারত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাদের অনেকেই এ বিষয়টি নিয়ে আবেগঘন বক্তব্য রেখেছেন। তবে ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ নিয়ে এখন আর তেমন বক্তব্য শোনা যায় না। সব ধর্ম, বর্ণ ও ভাষার মানুষকে নিয়ে মানবিক সমাজ বিনির্মাণের বদলে বিজেপি আমলে তো ভেদ-বিভেদ ও হিংসার কথাই বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন জাগে-বাগানে আগুন লাগালে, কোনো কোনো ফুলকে উচ্ছেদ করলে, বাগানের চর্চা ও পানি বণ্টনে বৈষম্য করলে, বাগানের শ্রী কি নষ্ট হয়ে যাবে না? এমন বাগানের মালিকে কি মানুষ পছন্দ করবে? বিষয়টি নিয়ে নরেন্দ্র মোদি এবং তার প্রশাসন ভাবলে ভালো করবেন।

হঠাৎ বাগান নিয়ে কেন এত কথা? এর সঙ্গত কারণ রয়েছে। ৩০ আগস্ট ভারতের জি-নিউজ পরিবেশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে ইসলাম ও মুসলিমদের নিয়ে রাজনৈতিক বিদ্বেষ যে কোনো সময়ের তুলনায় ভয়াবহ পরিস্থিতিতে রয়েছে। বিজেপি সরকারের অনেক এমপি-মন্ত্রী প্রকাশ্যেই মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্য দেন। তবে বিজেপির আদর্শিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবত এবার বললেন ভিন্ন কথা। গত ২৮ আগস্ট নয়াদিল্লিতে আরএসএস-এর শতবর্ষ উদযাপনের এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে মোহন ভাগবত বলেন, ইসলাম তার আগমনের পর থেকেই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এবং থাকবে। যারা এর অন্যথায় মনে করে, তারা হিন্দু দর্শন বোঝে না। তিনি আরও বলেন, ‘যারা মনে করে ইসলাম থাকবে না, তারা হিন্দু দর্শন দ্বারা পরিচালিত নয়। হিন্দু দর্শন এমনটা ভাবে না। উভয় পক্ষে বিশ্বাস থাকলে তবে এ সংঘাতের অবসান হবে। তিনি বলেন, পারস্পরিক আস্থা ও ঐক্যের মাধ্যমে একটি সম্মিলিত সমাজ গঠনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বৈচেত্র্যের ঐক্যের কথা বললেন। হিন্দু-মুসলিম সবাইকে নিয়ে সম্মিলিত সমাজ গঠনে এগিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। তিনি আরও বলেছেন, ইসলাম তার আগমনের পর থেকেই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এবং থাকবে। চমৎকার বলেছেন মোহন ভাগবত। কিন্তু প্রশ্ন, এমনই যখন আরএসএস-এর ভাবনা, তখন শিষ্য বিজেপি এবং নরেন্দ্রমোদি সরকার ভিন্ন পথে চলে কেমন করে? কম শিক্ষিত বিজেপি নেতা-কর্মীদের কথা না-ই বা বললাম, বিজেপি সরকারের এমপি-মন্ত্রীরা কী করে প্রকাশ্যে মুসলিমবিদ্বেষী উগ্র বক্তব্য প্রদান করেন? এর প্রভাব তো ভারতীয় সমাজে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভারতে মুসলমানদের মসজিদ ভাঙ্গা হচ্ছে, মসজিদের জায়গায় মন্দির নির্মাণের প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মুসলমানদের খাদ্য ও পোশাকের ওপরও হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। উগ্র হিন্দুরা প্রায়ই দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করে ভারতীয় মুসলমানদের পাকিস্তানে চলে যেতে বলছে। এসব কিসের আলামত? মোহন ভাগবতের মতে তো, এরা হিন্দু দর্শন দ্বারা পরিচালিত নয় এবং এরা প্রকৃত হিন্দু নয়। তাহলে এরা করা, যারা মুসিলমান বিদ্বেষী দাঙ্গা-হাঙ্গামা চালিয়ে যাচ্ছে? এখানে এসে একটি প্রশ্নের উদ্রেক হয়, আরএসএস-এর শতবর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে মোহন ভাগবত যে চমৎকার বক্তব্য রাখলেন তা কি শুধু কথার কথা, নাকি আসলেই তিনি ওই বক্তব্যের প্রতিষ্ঠা চান? সামনের দিনগুলোতে মানুষ তার কথা ও কাজের হিসেবটা বুঝে নিতে চাইবেন।