কুরবানির ঈদ চলে গেল। হয়তো আগামী বছরও আমরা এ ঈদের সাক্ষাৎ পাবো। সাক্ষাৎ পেলে কি বড় কিছু হয়ে যাবে? গত বছরও তো সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম, এর আগের বছরগুলোতেও। কিন্তু তাতে তেমন কিছু তো হয়ে যায়নি। অথচ কুরবানি ঈদ; যাকে ঈদুল আজহা বলা হয়ে থাকে-এর ইতিহাস আছে, আছে বান্দা ও দরদী মানুষ হওয়ার বার্তা। কিন্তু এ বার্তা আমরা কতটা উপলব্ধি করছি কিংবা গ্রহণ করছি? ঈদের মূল বার্তা গ্রহণ না করলে তো আমাদের ঈদ অন্যান্য উৎসবের মতো একটি Ritual বা অনুষ্ঠান সর্বস্বতায় পরিণত হবে। ঈদকে প্রাণবন্ত ও কার্যকর অবস্থায় পেতে হলে আমাদের এর Spritual দিকটি উপলব্ধি করা দরকার। প্রশ্ন উঠতে পারে, বর্তমান সময়ে মুসলমানরা যেভাবে ঈদ পালন করছে, অর্থাৎ প্রথাগত আচারানুষ্ঠানের মাধ্যমে যা করছে, তার কি কোনো গুরুত্ব নেই? গুরুত্ব থাকবে না কেন? সদর্থক কর্মের একটা গুরুত্ব তো থাকবেই। ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে যে উৎসব, ঈদের ময়দানে সালাত, কোলাকুলি; আল্লাহ জন্য পশু কুরবানি, গোস্ত বন্টন, দাওয়াত-আপ্যায়ন, এসব কাজের অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। চোখ মেলে তাকালে তা উপলব্ধি করা যাবে।

আমরা বলতে চাইছি, Ritual-এর চাইতে Spritual দিকটা অধিকতর পুরুত্বপূর্ণ; এটাই আসল। আমরা যদি ঈদুল আজহার আত্মিক বা আধ্যাত্মিক দিকটি উপলব্ধি করতে পারি, তাহলে আমরা এ ঈদের Sprit বা চেতনা ধারণ করতে সক্ষম হবো ইনশাআল্লাহ। আমরা জানি, কুরবানি ঈদের একটা ইতিহাস আছে, আছে প্রেক্ষাপট। বিষয়টি মুসলিম সমাজে গল্পের মতো ছড়িয়ে গেছে। গল্পের মত হলেও বিষয়টি সত্যি। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এ কাহিনী-“অতঃপর যখন তার ছেলে তার সাথে চলাফেরা করার মত বয়সে উপনীত হলো তখন ইবরাহীম বললো, হে প্রিয় বৎস, আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি জবেহ করছি, অতএব দেখ তোমার কী অভিমত? পুত্র বললো : হে আমার পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তা করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। অতঃপর যখন তারা উভয়ই আত্মসমর্পণ করলো এবং ইবরাহীম তার পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিল, তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, হে ইবরাহিম তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছো-স্বপ্নাদেশ পালন করেছো-এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান জবেহের বিনিময়ে।” (সূরা সাফ্ফাত, আয়াত ১০২-১০৭)

ইবরাহিম (আ:) নবী ছিলেন। এজন্য তাঁর স্বপ্ন ছিল ওহী। এখানে লক্ষ্য করার মত বিষয় হলো, পিতা যখন পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিলেন জবেহের নিয়তে, তখন আল্লাহ ইবরাহিম (আ:)কে বললেন, স্বপ্নাদেশ পালন হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ মন থেকে কুরবানি হয়ে গিয়েছে। হযরত ইবরাহিম (আ:) এবং ইসমাইল (আ:) মন থেকে মহান আল্লাহর আদেশ মেনে নিয়েছেন। তাঁদের মনের এ কুরবানি ছিল নিখাঁদ ও অকৃত্রিম। এ কারণেই পুত্রকে শায়িত করার সাথে সাথেই আল্লাহ ইবরাহিম (আ:)কে জানিয়ে দিলেন, তোমার কুরবানি কবুল হয়ে গিয়েছে। আল্লাহ জান্নাতি এক দুম্বা দিয়ে কুরবানির ব্যবস্থা করলেন। অভূতপূর্ব এ ঘটনার মূল বার্তা হলো নিয়তের বিশুদ্ধতা। নিজের সম্পদ বা প্রিয় বস্তু একমাত্র আল্লাহর সন্তুর্ষ্টির জন্য বিলিয়ে দেওয়াই হলো প্রকৃত কুরবানি। আমরা প্রতি বছর ঈদুল আজহায় যে পশু কুরবানি দিচ্ছি, তা হযরত ইবরাহীম (আ:)-এর কুরবানির অনুসরণ।

ঈদুল আজহায় আমরা পশু কুরবানির মাধ্যমে হযরত ইবরাহীম (আ:)-এর অনুসরণ করছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ অনুসরণ কতটা Ritual, আর কতটা Spritual ? কুরবানির শিক্ষা বহুমাত্রিক। কুরবানির পশুর গোস্ত তিনভাগ করার তাৎপর্য কী? ব্যক্তি বিশেষের কুরবানিতে শরিক হয়ে গেলেন দরিদ্র মানুষ, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, নিজেরও একটা অংশ আছে। আমরা যে ‘দরদী সমাজের’ কথা বলছি, কুরবানির গোস্ত বিতরণে কি সে শিক্ষা নেই? ঈদুল আজহায় তো পশুর গোস্তের তিনভাগের একভাগ আমরা দরিদ্রকে দিয়ে থাকি। সারাবছর কি এ চিত্র অব্যাহত থাকে? দরিদ্র ও দুঃখি মানুষের কল্যাণে আমরা আমাদের সম্পদের কত অংশ ব্যয় করি? অপচয়ের তুলনায় তা কি খুব কম নয়? এজন্য কিন্তু আমাদের জবাবদিহি করতে হবে। কুরবানির Sprit যদি যাপিত জীবনে আমরা রক্ষা করতে পারি, তাহলে আমাদের সমাজ হবে দরদী সমাজ। এমন সমাজের সদস্যরা তো অপচয়কারী হবে না, বরং হবে দরদী।