ঝলমলে আধুনিক সভ্যতায় রীতিমত মাস্তানি চলছে। শুধু হামলার মাস্তানি নয়; চলছে ভাষার মাস্তানিও। সভ্যতার শাসকদের দিকে কর্ণপাত করলে বিষয়টি সহজেই উপলব্ধি করা যায়। ইরানে নৃশংস হামলা চালালো ইসরাইল, অথচ এ হামলার জন্য ইরানকেই দূষছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার ভাষ্যমতে, পরমাণু প্রকল্প নিয়ে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের দাবি মেনে না নেওয়ায় এ হামলা হয়েছে। ইরানকে পরমাণু চুক্তিতে রাজি হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ট্রাম্প বলেছেন, দেশটিতে আরও বড় হামলা হতে পারে।’ এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, পরমাণু চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের আলোচনার মধ্যেই দেশটিতে নৃশংস হামলা চালালো ইসরাইল। শুক্রবার ভোররাতে ইরানে হামলা চালায় ইসরাইল। অথচ রোববার ওমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে ষষ্ঠ দফায় বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র জানতো, আবার শুক্রবার ইসরাইলের হামলার কথাও ট্রাম্প প্রশাসনের জানা ছিল। আমরা কোন দুনিয়ায় বসবাস করছি? সবকিছু প্রহসনের মত মনে হচ্ছে।
এমন বাস্তবতায় নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ডোনাল্ড ট্রাম্প লেখেন, ‘এরই মধ্যে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে এবং বহু মানুষ মারা গেছেন। তবে এ হত্যা এবং আরও পাশবিক হামলার পরিকল্পনা থামাতে এখনো সময় আছে। সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার আগে এবং এক সময়ের পরিচিত ইরান সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখতে ইরানকে অবশ্যই একটি চুক্তি করতে হবে।’ ট্রাম্পের এমন বক্তব্যে উপলব্ধি করা যায়, নেতানিয়াহু তার এক বিশ্বস্ত বরকন্দাজ। ট্রাম্পের কথামত ইরান চুক্তি না করলে ইসরাইল ইরানকে ধ্বংস করে দেবে। এতো রীতিমত মাস্তান মার্কা হুমকি। তবে মাস্তানের মধ্যেও তারতম্য আছে। কেউ পাড়ায় মাস্তানি করে, কেউ রাষ্ট্রে, কেউবা বিশ্বে। মাস্তান ছোট বা বড় হোক, হোক আন্তর্জাতিক-মাস্তান তো মাস্তানই। দুর্জন হওয়ার কারণে মাস্তানকে মানুষ ভয় করতে পারে, তবে সম্মান বা সমীহ করে না। সম্মান না করার আর একটি কারণ হলো; মাস্তান কখনো সমাজ, রাষ্ট্র বা বিশ্বের কল্যাণে আসে না। অন্যায়, অনাচার, অবিচার ও নিপীড়ন চালাতে চালাতে এক সময় সে নিজেও ধ্বংস হয়ে যায়। তার ধ্বংসে মানুষ খুশি হয়। ইতিহাস এর সাক্ষী।
ইরানের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে বহু আগে থেকেই পশ্চিমা বিশ্বের আপত্তি। ইরানের দাবি, সে সামরিক উদ্দেশ্যে তার পারমাণবিক শক্তিকে কাজে লাগাতে চায়। তবে তা মানতে নারাজ ইসরাইলসহ পশ্চিমা দেশগুলো। তাদের ভাষ্য, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতেই তেজষ্ক্রিয় পদার্থসমৃদ্ধ করছে তেহরান। আর মাধ্যপ্রাচ্যে ইরানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র এলে তা এ অঞ্চলে বড় ঝুঁকি তৈরি করবে। এমন বক্তব্যে প্রশ্ন জাগে, বাস্তব পরিস্থিতি আসলে কী? মধ্যপ্রাচ্যের জন্য বড় ঝুঁকি কে তৈরি করছে-ইসরাইল নাকি ইরান? আসলে মাধ্যপ্রাচ্যের জন্য বড় বিপদ হলো যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্র ইসরাইল। অথচ রাষ্ট্রটির হাতে রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র। আর একটি প্রশ্ন হলো, ইসরাইলের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকলে, ইরানের হাতে তা থাকতে বাধা কোথায়? আরও বড় প্রশ্ন হলো, কারো হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকা বা না থাকার মানদণ্ড কী? আর কারা, কিসের ভিত্তিতে সে মানদণ্ড ঠিক করবেন? আসলে ন্যায়বর্জিত ও মাস্তানমণ্ডিত এক অমানবিক সভ্যতায় এখন আমাদের বসবাস। এখানে শান্তির কোনো সংলাপ নেই।
এমন বাস্তবতায় ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান তার কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলেন, ইসরাইলের হামলায় নিহত প্রত্যেক নাগরিকের রক্তের প্রতিশোধ নেওয়া হবে। ইসরাইলের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এমন বর্বর শাসকের সঙ্গে শুধু শক্তির ভাষায়, কথা বলা উচিত।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এ মুহূর্ত থেকেই ইরানের ইসলামিক প্রজাতন্ত্র সরকার প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা, রাজনৈতিক ও আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যাতে অবৈধ ইসরাইলকে তার আগ্রাসনের জন্য অনুতপ্ত করা যায় এবং ইসরাইলিরা এক মুহূর্তও বিশ্রাম নিতে না পারে। আর বিশ্ব এখন ইরানের পারমাণবিক প্রযুক্তি ও ক্ষেপণাস্ত্র ক্ষমতার উন্নয়ন ও অধিকারের প্রতি তেহরানের দৃঢ় অবস্থান সম্পর্কে আরো ভালোভাবে বোঝার সুযোগ পেয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্টের বিবৃতিতে সুস্পষ্ট বার্তা রয়েছে। ইসরাইলের আগ্রাসনের জবাবে এমন বার্তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বরকন্দাজ নেতানিয়াহকে নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যেতে চান?