গাজা উপত্যকায় মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা প্রতিদিন নতুন চরমে পৌঁছাচ্ছে। সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইল আরোপিত অবরোধ ও দুর্ভিক্ষের ফলে ১৫ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের মধ্যে চারজন শিশু। এমন হৃদয়বিদারক পরিসংখ্যান আরেকবার স্পষ্ট করে দিল যে, বোমার পাশাপাশি ক্ষুধাও এখন ইসরাইলি আগ্রাসনের একটি ‘কৌশলগত অস্ত্র’।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত গাজায় অপুষ্টিজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১০১ জনের, যাদের মধ্যে ৮০ জনই শিশু। এটি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফল নয়, বরং একটি রাষ্ট্র কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়িত নীতির ভয়াবহ পরিণতি। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ যথার্থভাবেই এ পরিস্থিতিকে বর্ণনা করেছে “বেসামরিক জনগণকে না খাইয়ে মারার” প্রচেষ্টা হিসেবে। এ গণদুর্ভিক্ষ যে নিছকভাবে মানবিক ব্যর্থতা নয়, বরং একটি রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একাধিক আন্তর্জাতিক সূত্রের রিপোর্টে। ইউএনআরডব্লিউএ -এর অভিযোগ অনুযায়ী, ইসরাইল এখন এক মিলিয়ন শিশুসহ সমগ্র গাজার জনগণকে খাদ্য, ওষুধ ও ন্যূনতম সহায়তা থেকে বঞ্চিত করছে। এ অবরোধ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং যুদ্ধ আইনের চরম লঙ্ঘন। আরও ভয়ংকর বিষয় হলো, সামান্য যে সহায়তা গাজায় পৌঁছাচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল-সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের সামরিক বিতরণ কেন্দ্রগুলো। যেসব সাধারণ মানুষ সেখানে খাবার নিতে যান, তাদেরও গুলি করে হত্যা করছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী। এতে করে একটি প্রশ্ন সামনে আসেÑএটা কি কেবল অবরোধ, না কি পরিকল্পিত গণহত্যা?
গাজার সিভিল ডিফেন্স সংস্থার মতে, শিশুদের অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর হার দ্রুত বাড়ছে। সংস্থার মুখপাত্র মাহমুদ বাসসাল ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “এ হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলোর কারণ সরাসরি বোমাবর্ষণ নয়, বরং অভুক্ত থাকা, শিশুদের দুধের ঘাটতি এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি।”
এমন বাস্তবতায়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। যারা মানবাধিকারের ধারক ও বাহক হিসেবে নিজেদের দাবি করে, সে রাষ্ট্রগুলো যখন এই বিপর্যয়ের দায়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না, তখন তা এক ধরনের মৌন সমর্থন হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো, ইসরাইলের অবরোধ অবিলম্বে প্রত্যাহার, গাজার ভেতরে নিরাপদ মানবিক করিডোর স্থাপন এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বাধীন তদন্তের মাধ্যমে এই দুর্ভিক্ষ ও অপুষ্টিজনিত মৃত্যুকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব মানবিক রাষ্ট্র ও জনগণের উচিত, এই নীরব গণহত্যার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হওয়া। ইতিহাস একদিন সব হিসেব চেয়ে নেবে, কিন্তু তার আগেই আমাদের ভূমিকা নেওয়ার সময় এখনই। গাজার শিশুদের মুখের দুধ কেড়ে নেওয়া, তাদের না খাইয়ে মারার এ নিষ্ঠুর কৌশল সভ্যতার জন্য এক কলঙ্ক। এটি কেবল যুদ্ধ নয়, এটি একটি আত্মার হত্যাকা- এবং আমাদের নীরবতাÑতা যত কৌশলী বা কূটনৈতিকই হোক না কেনÑতা ভবিষ্যতের বিবেচনায় হত্যাকা-েরই অংশীদারিত্ব হিসেবেই গণ্য হবে। এই বাস্তবতায়- বিবেক ও ইতিবাচক চেতনা থেকেই প্রতিটি সচেতন মহলকে ন্যায়নিষ্ঠ ভূমিকা পালনে অবিলম্বে তৎপর হতে হবে।