সানিয়া তাসনিম লামিয়া
কল্পনা করুন, এক ছোট শিশু মিষ্টির দোকানে দাঁড়িয়ে আছে। রঙিন চকলেটগুলো চোখের মধ্যে ঝলমল করছে এবং সে খুশি হয়ে এগুলো কিনতে চায়। কিন্তু সে জানেনা সে উজ্জ্বল রঙের আড়ালে লুকিয়ে আছে ক্ষতিকর রাসায়নিক -এক টুকরো আনন্দের বিনিময়ে স্বাস্থ্য হারানোর ভয় । বাস্তব জীবনে আমাদের বাজারের দৃশ্য প্রায় একই রকম। চকচকে ফল, টাটকা মাছ, দীর্ঘ সময় টিকে থাকা মাংস সব কিছুতেই মেশানো হচ্ছে ফরমালিন, কার্বাইড এবং কৃত্রিম রঙ। মানুষের চোখে যা সুন্দর তা শরীরে বিষ হয়ে ঢুকছে। শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশের বাজারে খাদ্য ভেজাল এমন এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যা নীরব মহামারীর মত মানুষের জীবনকে গ্রাস করছে। বাজারে গেলেই দেখা যায় রঙিন মিষ্টি, চকচকে ফল, টাটকা দেখানো মাছ বা মাংস সব কিছুতেই মেশানো হচ্ছে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ। ফরমালিন, কার্বাইড, কৃত্রিম রং এমন কি টক্সিক কেমিক্যাল পর্যন্ত ব্যবহার হচ্ছে খাবারের শর্ত জুতা ও আকর্ষণ বাড়ানোর নামে। কিন্তু এ বাহ্যিক সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে প্রাণঘাতি বিপদ। সাধারণ মানুষ প্রতিদিন অজান্তেই সেসব ভেজাল খাদ্য গ্রহণ করছে এবং ধীরে ধীরে ভুগছে নানা জটিল রোগে, যেমন ক্যান্সার, লিভার, কিডনি ও হৃদরোগ। ভেজালের কারণে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে আর বয়স্কদের আয়ু কমে যাচ্ছে। অথচ খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার যা নিরাপদ হওয়া উচিত। ফলে খাদ্যে ভেজাল এখন শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা নয় বরং জাতীয় জনস্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক ভয়াবহ হুমকি।
সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে দেশের ৭৫% সাধারণ মানুষ খাদ্যে ভেজালের শিকার হওয়ায় ভয়ে বাজার থেকে খাবার কিনতে দ্বিধা করে। বিশেষ করে শিশু এবং বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি চোখের মধ্যে। ৬০% পরিবার স্বীকার করেছে তারা দীর্ঘদিন ধরে রঙিন ফল বা টাটকা দেখানো খাবার কিনে এসেছে, অজান্তেই ভেজাল গ্রহণ করছে। ৫৫% মানুষ মনে করে সরকার ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের অনিয়ম এবং মনিটরিং এর অভাবই এই পরিস্থিতির মূল কারণ। জরিপে প্রকাশ, অধিকাংশ মানুষ চাইছে নিরাপদ, জৈব ও সার্টিফাইড খাবার, কিন্তু সেগুলো বাজারে কম এবং দামে বেশি। এটি প্রমাণ করছে সচেতনতা বাড়লেও বাস্তবতা এখন বিপদজনক।
খাদ্যে ভেজালের মূল কারণ হলো ব্যবসায়ীদের মুনাফার লোভ। বেশি লাভের আশায় তারা রঙিন ফল, চকচকে মিষ্টি, দীর্ঘ সময় টিকে থাকা মাছ-মাংসের মধ্যে ফরমালিন, কার্বাইড এবং কৃত্রিম রং এবং অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করে। ভোক্তাদের অবদান কম নয়, কম দাম ও আকর্ষণীয় রং দেখে মানুষ সচেতন না হয়ে এসব খাদ্য ক্রয় করে। এছাড়া বাজারে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং এর অভাব ও সমস্যাকে বাড়িয়ে দেয়। আইন থাকলেও কঠোরভাবে প্রয়োগ না হওয়ায়, দোষীদের শাস্তি না দেওয়া এবং দুর্নীতির কারণে ভেজালের বিস্তার থামছে না। শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব ও এর কারণ, অনেক পরিবার জানে না কোন খাদ্য নিরাপদ কোনটা ক্ষতিকর। এভাবে লোভ, সচেতনতার অভাব এবং নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা একত্রিত হয়ে খাদ্যে ভেজালের মহামারী সৃষ্টি করছে যা শিশু থেকে বড় সবার স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
খাদ্যে ভেজাল রোধ করতে একদিকে কঠোর আইন প্রয়োগ করা অপরিহার্য। সরকারের উচিত নিয়মিত বাজার মনিটরিং, অনিয়মী ব্যবসায়ীদের দ্রুত শনাক্তকরণ এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ব্যবসায়ীদের সচেতন করতে কর্মশালা, ট্রেনিং এবং বক্তা শিক্ষার মাধ্যমে মানবিক দায়িত্ব বোঝানো যেতে পারে। অন্যদিকে ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খাবার কিনতে গেলে শুধু দাম এবার রং এর দিকে নয়, প্রামানিক লেবেল, সার্টিফাইড পণ্য এবং ডিজিটাল রিভিউ যাচাই করে নিতে হবে। স্কুল ও মিডিয়ার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত শিক্ষামূলক প্রচার চালানো যেতে পারে। এছাড়া জৈব ও নিরাপদ খাদ্যের চাহিদা বাড়িয়ে ব্যবসায়ীদের নৈতিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা সম্ভব। এ উদ্যোগগুলো সম্মিলিতভাবে বাস্তবায়ন করলে খাদ্যে ভেজালের বিস্তার কমানো সম্ভব, শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা সম্ভব এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিরাপদ খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করা যায়।
সুতরাং খাদ্যে ভেজাল রোধ করা আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। শুধুমাত্র আইন থাকলেই হবে না এর যথাযথ বাস্তবায় নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবসায়ীদের কেবল মুনাফার চেয়ে মানুষের স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে আর বক্তাদের সচেতন হতে হবে, দামে বা আকর্ষণীয় রঙে নয় নিরাপদ এবং সার্টিফাইড খাবার বেছে নিতে হবে। শিক্ষা, মিডিয়া এবং সরকারি প্রচার অভিযানের মানুষকে সচেতন করা গেলে ভেজাল খাদ্য ব্যবহারের সংখ্যা কমানো সম্ভব। নিরাপদ খাদ্য শুধুমাত্র স্বাস্থ্য সংরক্ষণ নয় এটি শিশু ও প্রজন্মের সঠিক বিকাশ নিশ্চিত করে। তাই ব্যক্তিগত সচেতনতা, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং সামাজিক শিক্ষার সমন্বয়ে আমরা খাদ্যে ভেজালের ভয়াবহতা কমাতে পারি। শেষমেষ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা মানে আমাদের দেশের সুস্থ ও ভবিষ্যতের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।