বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো একটি রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের প্রাক-স্বাধীনতা বিভিন্ন আন্দোলনে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে এ দলটি নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ পেয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম সরকার গঠনের গুরু দায়িত্বও পেয়েছিল দেশটি। তুমুল জনপ্রিয়তা ও প্রত্যাশা নিয়ে ক্ষমতায় আসা দলটি মাত্র সাড়ে তিন বছরের ব্যবধানে সবচেয়ে বিতর্কিত এবং অগ্রহণযোগ্য দলে পরিণত হয়। প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের ইতিহাস থেকে বাংলাদেশের সবদল ও প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষা নেয়ার মতো সুযোগ রয়েছে। সুদীর্ঘ পথচলার এক পর্যায়ে এসে যদি আওয়ামী লীগের মতো কোনো দল নিষিদ্ধ হয়। তবে সেটি কেবল একটি রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয়, এটি সাংগঠনিক, নৈতিক ও গণতান্ত্রিক ব্যর্থতারও প্রতীক। আর তাই, এ ঘটনায় অন্য দলগুলোর জন্যও গভীর চিন্তার খোরাক রয়েছে।

একটি রাজনৈতিক দল রাতারাতি নিষিদ্ধ হয়ে যায় না। এর পেছনে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে জমে ওঠা একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত, জনবিচ্ছিন্নতা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বচ্ছতার অভাব। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। দলটি দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকায়, ক্রমেই নিজের চারপাশে একটি “দুর্গ” গড়ে তুলেছিলÑযেখানে সমালোচনার স্থান ছিল না, প্রশ্নের অধিকার ছিল না, বরং ব্যক্তিনির্ভরতা, চাটুকারিতা এবং অন্ধ আনুগত্যই হয়ে উঠেছিল টিকে থাকার মাপকাঠি।

দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। অধিকাংশ সিদ্ধান্ত হতো কেন্দ্র থেকে। তাও আবার একটি বিশেষ বৃত্ত বা গোষ্ঠীর মাধ্যমে। স্থানীয় নেতৃত্ব, তৃণমূল কর্মী, এমনকি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও ক্রমশ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাইরে চলে যায়। দলীয় গঠনতন্ত্র ও নিয়মনীতি কার্যত ছিল কাগজে-কলমেÑবাস্তবে তার প্রয়োগ ছিল সীমিত। যেখানে রাজনীতি হওয়া উচিত ছিল গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন, সেখানে আওয়ামী লীগের রাজনীতি রূপ নেয় ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার যন্ত্রে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে বিরোধী কণ্ঠরোধ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে রেকর্ড করেছিল তারা। এ ধরনের অনাচারের ফলেই দলটির গণভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গুম, খুন, আয়নাঘর, অর্থপাচার, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসি দেয়া, ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করা, বিডিআর বিদ্রোহের নামে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যাসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে।

জনপ্রিয়তা কোনো চিরস্থায়ী বিষয় নয়। জনপ্রত্যাশা পূরণের সাথে জনপ্রিয়তা অনেকটাই নির্ভরশীল। তাই যখনই কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দল নিজেকে জনপ্রিয় মনে করেন এবং এটিকেই স্থায়ী বলে ধরে নেন, তখন থেকে তার পতনও শুরু হয়ে যায়। এমনিতেও শাসন ক্ষমতায় গেলে একটি দল ও ব্যক্তির সাথে জনগণের অনেকটুকু দেয়াল তৈরি হয়ে যায়। জনগণের আশা, আকাক্সক্ষা বা না পাওয়াগুলো তখন আর ক্ষমতাসীনদের কানে পৌঁছায় না। তারা নিজেদের মতো করে একটি সুরক্ষিত কাঠামোর ভেতর কাঠের চশমা পরে বসে থাকেন। তাদের কাছে কেবল ইতিবাচকতা আর উন্নয়নই ধরা পড়ে। আওয়ামী লীগও এই ফাঁদেই পড়েছিল।

প্রকৃতপক্ষে সস্তা জনপ্রিয়তা নয় বরং নৈতিকতা ও জনভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তি অনেক বেশি স্থায়ী ও প্রভাবশালী হয়। দলীয় শৃঙ্খলা মানেই অন্ধ আনুগত্য নয়; বরং দলীয় শৃঙ্খলা মানে ন্যায্য নিয়মের মধ্যে মতপার্থক্যের সহাবস্থান নিশ্চিত করা। বর্তমানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেক দলই মনে করছে, আওয়ামী লীগের পতন তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করেছে। সেক্ষেত্রেও তাদের মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগের মতো একই পথ তারা অনুসরণ করলে তাদের পরিণতিও একই হবে। জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ আমূল বদলে দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখতে হবে যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দল মানে কেবল নির্বাচনে অংশগ্রহণ নয়, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করা। দল পরিচালনায় নিয়মতান্ত্রিকতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরামর্শ ভিত্তিকতা এবং নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব পরিবর্তনের সংস্কৃতি গড়ে তোলাও আবশ্যক।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ হওয়া শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনার প্রতিফলন নয়, এটি একটি দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে ওঠা স্বেচ্ছাচার, অহংকার ও জনবিচ্ছিন্নতার পরিণতি। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে যদি অন্য দলগুলো নিজেদের শোধরায়, গণতন্ত্রের মূল চেতনায় ফিরে আসে, তবে এটিই হতে পারে বাংলাদেশ রাজনীতির জন্য এক নতুন সূচনা। আওয়ামী লীগের এ পতন যেন কেবল অন্য আরেকটি দলের উত্থান নয়, বরং গোটা রাজনীতির জন্য একটি বোধোদয় হয়ে উঠুকÑএমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।