রাজধানীর মানুষের স্বপ্নের প্রকল্প মেট্রোরেল নিঃসন্দেহে দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী উদ্যোগ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক “বিয়ারিং প্যাড” খুলে পড়ার ঘটনা এবং এসব ঘটনায় সাধারণ পথচারীসহ নাগরিকদের মর্মান্তিক মৃত্যু সাধারণ যাত্রী থেকে শুরু করে প্রকৌশল বিশেষজ্ঞÑসবাইকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। কারণ, মেট্রোরেল কেবল একটি পরিবহন ব্যবস্থা নয়; এটি একটি উচ্চপ্রযুক্তিনির্ভর অবকাঠামো, যেখানে সামান্য ত্রুটিও বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। অতিসম্প্রতি বিয়ারিং প্যাড খুলে নীচে পড়ে একজন মানুষের মৃত্যু আবারও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে-অত্যাধুনিক অবকাঠামো নির্মাণে আমরা এখনো পদ্ধতিগত শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা সংস্কৃতিতে অনেকটাই পিছিয়ে আছি।

মঙ্গলবারে প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলোর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালুর আগে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা নিরীক্ষা বা অডিট করা হয়নি। এটি যেকোনো বড় প্রকল্পের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের পরিপন্থী। বিশ্বজুড়ে এমন প্রকল্প চালুর আগে স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞ দল দ্বারা মান ও নিরাপত্তা যাচাই বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশে সে প্রক্রিয়া উপেক্ষা করা হয়েছে -এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যেনতেনভাবে মেট্রোরেল চালুর জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তাড়াহুড়ো করেছিল- এমন অভিযোগ নতুন নয়। নির্বাচনের আগে জনগণের কাছে উন্নয়ন প্রদর্শনের মানসিকতা অনেক সময় প্রকল্পের পেশাদারিত্ব ও নিরাপত্তাকে ছাপিয়ে যায়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের এ ধরনের মানসিকতা দেশ ও জাতির জন্য খুবই বিপজ্জনক। উন্নয়নের প্রকৃত মূল্য তখনই পাওয়া যায়, যখন তা টেকসই ও নিরাপদ হয়। রাজনৈতিক সাফল্যের জন্য মানুষের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৃতীয় পক্ষের নিরীক্ষা হলে প্রকল্পের সূক্ষ্ম ত্রুটি, ডিজাইন বা নির্মাণজনিত বিচ্যুতিÑসবকিছুই আগে ধরা পড়ত। এখন যখন একের পর এক “বিয়ারিং প্যাড” খুলে পড়ছে, তখন তা প্রতিকারের বদলে অনাকাক্সিক্ষত বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে। “বিয়ারিং প্যাড” হলো মেট্রোরেলের উড়ালপথ ও পিলারের সংযোগস্থলÑঅর্থাৎ পুরো কাঠামোর স্থিতিশীলতা নির্ভর করে এই অংশের ওপর। বিয়ারিং প্যাডগুলো সাধারণত ২০ থেকে ২৫ বছর স্থিতিশীল থাকে। কিন্তু মাত্র এক-দেড় বছরের মধ্যেই এটি খুলে পড়া নিঃসন্দেহে গভীর প্রযুক্তিগত ত্রুটি কিংবা রক্ষণাবেক্ষণ ঘাটতির প্রমাণ।

নিরাপত্তা নিরীক্ষা না করা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়মিত প্রতিবেদন না দেওয়া আইনি ও প্রশাসনিক দায়িত্ব অবহেলার শামিল। “মেট্রোরেল আইন, ২০১৫” ও “বিধিমালা, ২০১৬” অনুসারে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়মিত নিরাপত্তা প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। অথচ এখন পর্যন্ত একটি প্রতিবেদনও জমা হয়নি। প্রশ্ন জাগে ৩৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে কেন এমন শৈথিল্য? যেখানে এক কিলোমিটার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা, সেখানে মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে যথাযথ ব্যবস্থা না থাকা প্রকল্প ব্যবস্থাপনার গভীর দুর্বলতার প্রমাণ। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, ঠিকাদার এবং প্রকল্প পরিচালনাকারী সংস্থাÑসবাইকেই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

বর্তমান কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব এখন শুধু ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেরামত নয়, বরং পুরো ব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়ন। প্রতিটি পিলারের বিয়ারিং প্যাডের অবস্থান, সংযোগ ও স্থিতিশীলতা ড্রোন প্রযুক্তি ও আধুনিক পর্যবেক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে পুনরায় পরীক্ষা করা জরুরি। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মান অনুসারে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা নিরীক্ষা করতে হবে এবং তার প্রতিবেদন প্রকাশ্য করতে হবে, যাতে জনগণের আস্থা ফিরে আসে। নিরাপত্তার পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়েও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। মেট্রোরেল শুধু নির্মাণে ব্যয়বহুল নয়, এর রক্ষণাবেক্ষণও উচ্চমানসম্পন্ন দক্ষতা দাবি করে। এজন্য প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদদের প্রশিক্ষণ, নিয়মিত পরিদর্শন, আর্থিক স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

আমরা বিশ্বাস করি, মেট্রোরেল বাংলাদেশের আধুনিক শহুরে যাতায়াত ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ। কিন্তু সে ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখতে হলে নিরাপত্তা ও মাননিয়ন্ত্রণে কোনো আপস চলবে না। উন্নয়ন তখনই অর্থবহ, যখন তা নিরাপদ, টেকসই এবং জনগণের আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে। এখনই সময় মেট্রোরেল প্রকল্পে পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা নিরীক্ষা শুরু করার-যেন আর কোনো “বিয়ারিং প্যাড” খুলে না পড়ে, আর কোনো আস্থা ভেঙে না যায়।