বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সুখবর পাওয়া যায় খুবই কম। নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত আমাদের অর্থনীতি। তারপরও মাঝে মাঝে অর্থনীতির জন্য দু’একটি ভালো সংবাদ পাওয়া যায়, যা আমাদের উল্লসিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন দেশের রপ্তানি পণ্যের উপর বাড়তি হারে শুল্কারোপের ঘোষণায় বিশ্বব্যাপী যখন প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, অধিকাংশ দেশই যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তাদের রপ্তানি পণ্যের চাহিদা কমে যাবার আশঙ্কায় রয়েছে ঠিক তখনই বাংলাদেশের জন্য একটি সংবাদ আশার সঞ্চার করেছে। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য তালিকায় সিংহভাগ জুড়ে আছে তৈরি পোশাক। আর তৈরি পোশাকের মধ্যে টি-সার্ট বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে বিভিন্ন দেশের রপ্তানি পণ্যের উপর বাড়তি শুল্কারোপের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশের রপ্তানিকারকগণ যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হারানোর আতঙ্কে রয়েছে ঠিক তখনই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, বিশেষ করে টি-সার্ট রপ্তানির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যের খবর এসেছে।
বিগত ৩৬ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ এবারই প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টি-সার্ট রপ্তানির ক্ষেত্রে সবার শীর্ষে উঠে এসেছে। ১৯৮৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে টি-সার্ট রপ্তানির ক্ষেত্রে হন্ডুরাস,নিকারাগুয়া, হংকং জ্যামাইকা এবং চীন ঘুরে ফিরে টি-সার্ট রপ্তানির ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্কারোপের ডামাডোলের মধ্যে বাংলাদেশ সব দেশকে অতিক্রম করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টি-সার্ট রপ্তানির ক্ষেত্রে সবার উপরে চলে এসেছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি-জুন সময়ে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে মোট ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের টি-সার্ট রপ্তানি করেছিল। আর চলতি পঞ্জিকা বছরের প্রথম ৬ মাসে অর্থাৎ জানুয়ারি-জুন সময়ে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে মোট ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের টি-সার্ট রপ্তানি করেছে। একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিকারাগুয়ার টি-সার্ট রপ্তানির পরিমাণ ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে কমে ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। বর্ণিত সময়ে হন্ডুরাসের টি-সার্ট রপ্তানি আয় ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে কমে ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। ভিয়েতনামের টি-সার্ট রপ্তানির পরিমাণ ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
সার্বিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্কনীতি নিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের মাঝে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল তা আপাতত দূর হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ আগামীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বর্ধিতহারে তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে পারবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের উপর ৩৭ শতাংশ শুল্কারোপ করার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। ভিয়েতনামের পণ্যের উপর ৪৬ শতাংশ এবং ভারতীয় পণ্যের উপর ২৬ শতাংশ বার্ধিত শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের উপর আরোপিত বাড়তি শুল্কহার ২ শতাংশ কমানো হয়েছিল। কিন্তু একই সময়ে ভিয়েতনামের পণ্যের উপর বাড়তি শুল্কহার ২৬ শতাংশ কমিয়ে ২০ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়। ভারতের পণ্যের উপর আরোপিত বাড়তি শুল্ক হার এক শতাংশ কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এতে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের মধ্যে উদ্বিগ দেখা দেয়। বিশেষ করে ভারতের রপ্তানি পণ্যের উপর বাংলাদেশের তুলনায় কম হারে শুল্কারোপের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাক বাজার ভারতীয় রপ্তানিকারকদের দখলে চলে যাবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল।
ভারত রাশিয়া থেকে জ¦ালানি তেল আমদানি বন্ধ করতে সম্মত না হবার কারণে শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় রপ্তানি পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ বাড়তি শুল্কের পাশাপাশি আরো ২৫ শতাংশ শাস্তিমূলক শুল্কারোপ করে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার দখল করার ভারতীয় রপ্তানিকারকদের খায়েশ মিটে যাবার উপক্রম হয়েছে। ভিয়েতনামও নানা সমস্যা, বিশেষ করে রুল অব অরিজিনের শর্ত মোতাবেক ৪০ শতাংশ কাঁচামাল স্থানীয়ভাবে যোগান দিতে না পারলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হারানোর আশঙ্কায় থাকবে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ আগামীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পাশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বর্তমানে তুলনায় আরো ভালো করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই শুল্ক জটিলতার কারণে যে সব অর্ডর বাতিল অথবা স্থগিত করা হয়েছিল তা আবারো সচল করা হচ্ছে। নতুন নতুন অর্ডার আসছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে তৈরি পোশাক রপ্তানির নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধান করতে হবে। তৈরি পোশাক শিল্পে কিভাবে স্থানীয় কাঁচামাল নির্ভরতা বাড়ানো যায় তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।