সম্পাদকীয়
খাদ্য মজুত হ্রাস উদ্বেগজনক
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্য মজুত পরিস্থিতি সন্তোষজনক বলে বায়বীয় দাবি করা হলেও এ দাবির কোন সত্যতা মিলছে না বরং দেশে খাদ্য মজুত পরিস্থিতি হ্রাস পেতে শুরু করেছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
Printed Edition
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্য মজুত পরিস্থিতি সন্তোষজনক বলে বায়বীয় দাবি করা হলেও এ দাবির কোন সত্যতা মিলছে না বরং দেশে খাদ্য মজুত পরিস্থিতি হ্রাস পেতে শুরু করেছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশে খাদ্যশস্যের মজুত পরিস্থিতির অনেকটাই অবনতি হয়েছে। জানা গেছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশে খাদ্যের মজুত ছিল সাড়ে ১৬ লাখ টন। সে তুলনায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে খাদ্যের মজুত কমেছে প্রায় ৩ লাখ টন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের ধীরগতি এবং আমদানি কমায় মজুত প্রক্রিয়া নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে চালের দাম বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন হলে তা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যা কোনভাবেই কাক্সিক্ষত নয়।
সূত্রমতে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পাঁচ মাসের মাথায় সরকারি পর্যায়ে খাদ্যশস্যের মজুত কমছে। যা কোনভাবেই বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। গত বছরের ৭ই আগস্ট দেশে মোট খাদ্যশস্যের মজুত ছিল ১৮ লাখ ৯ হাজার ৮৫৭ টন। এরমধ্যে চাল ও গমের মজুত ছিল যথাক্রমে ১২ লাখ ৯৭ হাজার ৪৭৪ টন ও ৪ লাখ ১৬ হাজার ৬৯৩ টন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন খাদ্যশস্যের মোট মজুত নেমে এসেছে ১৫ লাখ ৬৯ হাজার ৮৪৬ টনে। এরমধ্যে চালের মজুত রয়েছে ১০ লাখ ৮৪ হাজার ১২ টন। গমের মজুত আছে ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৮২২ টন। সে অনুযায়ী ৬ মাসে দেশে খাদ্যশস্যের মজুত কমেছে ২ লাখ ৪০ হাজার ১১ টন। এর আগে গত ৩রা ডিসেম্বর দেশে খাদ্যশস্যের মোট মজুত ছিল ১০ লাখ ৯০ হাজার ৩১৪ টন।
সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, খাদ্য আমদানি ও মজুত পরিস্থিতি আগের বছরের খানিকটা নিম্নমুখী। মূলত, বাজারে সরকারের কোনো কার্যকর মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ নেই। সর্বোপরি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকারকে সতর্ক করেছে। পুরনো সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয় থাকায় রমযানে বাজারে নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে পারে বলে আগেভাগেই সরকারকে জানিয়েছেন তারা। এদিকে রাজধানীর বাজারে মোটা চাল বিক্রি হয় ৫৪-৫৫ টাকা কেজিতে। মাঝারি মানের চালের দাম ছিল ৫৮-৬৪ টাকা। আর ৮০-৮৫ টাকায় বিক্রি হয় সরু চাল। যা সাধারণ মানুষের জন্য গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে।
মূলত, অভ্যন্তরীণ উৎস ও আমদানির মাধ্যমে চাল ও গম সংগ্রহ করে থাকে সরকার। রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডারে মজুত কমে আসার পেছনে প্রধানত সরকারিভাবে সময়মতো আমদানি করতে না পারাই দায়ী বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। তাদের ভাষ্যমতে, গত কয়েক মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে বলে বিগত সরকারের সময়ে বারবার দাবি করা হয়েছে। এরপরও দফায় দফায় চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। সে হিসাবে এবারো বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য আরও আগে থেকেই সরকারিভাবে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ ছিল।
সরকার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমানে আমন মৌসুমের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান চলছে। বন্যায় ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবার অভিযানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নাও হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে তা মজুত বৃদ্ধি ও বাজার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। কারণ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে সরকারিভাবে চাল আমদানির কার্যক্রম এরইমধ্যে অনেকটা এগিয়েছে। কয়েকটি চালান এরইমধ্যে প্রক্রিয়াধীন। আরও কয়েকটি উৎস থেকে আমদানির আলোচনাও শুরু হয়েছে। তাই, সরকারি মজুত নিয়ে এ মুহূর্তে উদ্বেগের কিছু নেই।
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার তদারকিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি ও দুর্বলতা রয়েছে। বাজার তদারকিতে আগের সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, বর্তমান সরকারও রয়েছে সে বৃত্তেই। সম্প্রতি এ বিষয়ে খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, ‘আমরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পর্যাপ্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এবারের দু’টি বন্যায় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে আমন উৎপাদনের সময় বন্যার জন্য আমরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছি। তবে সবকিছু মিলে খাদ্যশস্যের সরকারি মজুত ও আমদানিব্যবস্থা স্বাভাবিক আছে। আর ইউক্রেন-আর্জেটিনা থেকে গম আসবে। গম নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। দামও সহনশীল থাকবে’। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বন্যার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে সে কারণে সামনে খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিতও হতে পারে। সেটি মাথায় রেখে সরকারের মজুত বৃদ্ধি করা দরকার।
ভৌগোলিক আয়তনের তুলনায় আমাদের দেশ বিশ্বের সবচাইতে জনবহুল রাষ্ট্র। তাই জনসংখ্যা অনুসারে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুত করা জরুরি। পতিত সরকারের আমলে দেশের খাদ্য মজুত পরিস্থিতি নিয়ে নানাবিধ গালগল্প শোনানো হলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। প্রাপ্ত তথ্যমতে দেশে খাদ্য মজুত পরিস্থিতি খানিকটা হ্রাস পেয়েছে। তাই সরকারের উচিত অবিলম্বে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে খাদ্যশস্য অভিযান শুরু করা। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে আমদানী করে মজুত বৃদ্ধি করতে হবে। দেশে খাদ্যশস্য মজুত হ্রাস কোনভাবেই কাক্সিক্ষত নয়।