অঙ্গুলিটা আমরা সব সময় বড় বড় মানুষের দিকে তাক করে থাকি। তাক করা যেতেই পারে। কারণ বড় মানুষ হওয়ার কারণে তাদের অপরাধগুলোও বড় বড়। ফ্যাসিবাদী আমলে তো আমরা বড় বড় মানুষদের গুম-খুন, দুর্নীতি, অর্থপাচারসহ জঘন্যসব অপরাধের ঘটনা দেখেছি। মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, আমলা, সচিব, বাহিনী, কর্তা, সবাই অপরাধে জড়িত ছিলো। ফলে তাদের আমরা ভালো মানুষ বা সুনাগরিক হিসেবে বিবেচনা করি না। মন্দ মানুষের বদলে আমরা তো ভালো মানুষ চাই। যাঁরা হবেন ন্যায়পরায়ণ এবং মানবিক। এমন মানুষ কোথায় পাওয়া যাবে? অনেকেই মনে করেন, সাধারণ ও দরিদ্র মানুষরা ভালো মানুষ। কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতি ও সুযোগের আপেক্ষিকতায় সাধারণ ও দরিদ্র মানুষও যে কতটা ভয়ঙ্কর ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারেন তার উদাহরণ পাওয়া গেল শরীয়তপুরে।

ঢাকায় রোগী নিতে হলে এলাকার অ্যাম্বুলেন্সেই নিতে হবে। বাইরের অ্যাম্বুলেন্সে নেয়া চলবে না। স্থানীয় ড্রাইভারদের এমন দাবির মুখে অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখার ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে এক নবজাতকের। গত বৃহস্পতিবার রাতে শরীয়তপুরে এ ঘটনা ঘটে। হাসপাতাল কেন্দ্রিক অ্যাম্বুলেন্সচক্রের এমন নির্মমতা দেশে এর আগেও ঘটেছে। এ চক্র মূলত বেশি ভাড়া আদায়ের জন্য রোগীর স্বজনদের জিম্মি করে থাকে। মৃত নবজাতকটি শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার কনেশ্বর এলাকার নূর হোসেন সরদার ও রুমা বেগম দম্পতির সন্তান। বৃহস্পতিবার দুপুরে শরীয়তপুরের একটি ক্লিনিকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুটির জন্ম হয়। জন্মের পরই শ্বাসকষ্টসহ শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে চিকিৎসক তাকে ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দেন। বৃহস্পতিবার রাত আটটার দিকে ঢাকাগামী একটি খালি অ্যাম্বুলেন্স পেয়ে পাঁচ হাজার টাকা ভাড়ায় নবজাতককে নিয়ে স্বজনরা রওনা হন। কিন্তু চৌরঙ্গী মোড়ে স্থানীয় অ্যাম্বুলেন্সচালক সবুজ দেওয়ান অ্যাম্বুলেন্সটি আটকে দেন। সবুজের সঙ্গে আরও কয়েকজন স্থানীয় ড্রাইভার এ ঘটনায় অংশ নেন। এখানকার রোগী কেন তোলা হলো, এ কথা বলে ঢাকার ওই অ্যাম্বুলেন্স চালককে তারা মারধর করেন এবং গাড়ির চাবি নিয়ে নেন। ইতিমধ্যে দুপক্ষের দীর্ঘ তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে নবজাতকটি অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরেই বাবার কোলে মারা যায়। জন্মের পরপরই এক নির্মমতার শিকার হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল নবজাতকটি। সে হয়তো বলে গেল, এই পৃথিবী আর মানুষের বসবাসযোগ্য নেই।

রাজধানীর গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট থেকে সাধারণত দেশের দূরত্ব নিরূপণ করা হয়। গুগল ম্যাপের তথ্য অনুসারে, জিরো পয়েন্ট থেকে শরীয়তপুর জেলা শহরের দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। অ্যাম্বুলেন্স সেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, পথে কোনো বাধা না থাকলে শরীয়তপুর জেলা শহর থেকে পদ্মাসেতু হয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে একটি অ্যাম্বুলেন্সের দেড় ঘণ্টার বেশি সময় লাগে না। অথচ শরীয়তপুর থেকে ঢাকায় সিন্ডিকেটভুক্ত একটি অ্যাম্বুলেন্স ৮ হাজার টাকা থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া নিয়ে থাকে। এখানে কোনো বিবেচনা বা শৃংখলা লক্ষ্য করা যায় না। বিভিন্ন সময় পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, হাসপাতালের কর্মচারী, ওয়ার্ডবয়সহ প্রভাবশালীরা ‘সিন্ডিকেট’ করে অ্যাম্বুলেন্সের বেশি ভাড়া আদায় করেন। এ ভাড়া থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পেয়ে থাকেন চক্রের সদস্যরা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, হাসপাতালকে ঘিরে অ্যাম্বুলেন্সের মতো একটি জরুরি পরিবহন সেবায় এ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলছে বছরের পর বছর ধরে। অর্থলোভে অ্যাম্বুলেন্স চালকদের মধ্যে এক ধরনের ঐক্যও গড়ে উঠেছে। শুধু শরীয়পুরেই নয়, হাসপাতালকেন্দ্রীক অ্যাম্বুলেন্সচক্র গড়ে উঠেছে সারা দেশেই। শরীয়তপুরেই রয়েছে ২০টি অ্যাম্বুলেন্সচক্র। তারা রোগীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে থাকে। বিভিন্নভাবে হয়রানিও করে থাকে। ফলে উপলব্ধি করা যায়, শুধু বড় মাপের মানুষরাই নন, সুযোগ পেলে ছোট মাপের সাধারণ মানুষরাও অপরাধকর্মে নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারেন। নৈতিক অবক্ষয় ঘটলে ছোট-বড় সব মানুষই অমানুষ হয়ে উঠতে পারেন। অমানুষদের আইনের আওতায় না আনলে সমাজ মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে ওঠে। বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা বেশ ভালোভাবেই জানেন। এখন দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের মাধ্যমেই প্রশাসনের লোকজন তাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারেন।