ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ঋণের নামে ব্যাপক লুটপাটে দেশের ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোয় বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে। গতকাল দৈনিক সংগ্রামে ‘আওয়ামী সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় চলে লুটপাট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সে চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আওয়ামী লীগের আমলে ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোতে ঋণের নামে নজিরবিহীন লুটপাট হয়েছে। এ টাকার বড় অংশই বিদেশে পাচার করা হয়েছে। আদায় হচ্ছে না বলে এ অর্থ এখন খেলাপি ঋণে পরিণত হচ্ছে। ওই সময় সরকারের নীতিনির্ধারক ও ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা প্রভাব খাটিয়ে এসব অপকর্ম করেছেন বলে জানা গেছে।
প্রকাশ্যে এসব ঘটনা ঘটলেও ‘নীরব দর্শক’র ভূমিকায় ছিল কেন্দ্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংক। শুধু তাই নয়, আইনকানুনের কোনো তোয়াক্কা না করেই লুটপাটকারীদের সহায়তা করে নিজেরা (কেন্দ্রীয় এবং সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা) লাভবান হয়েছে। এর প্রভাবে দেশের অর্থনীতি আজ ‘খাদের কিনারায়’। এমন বাস্তবতায় শীর্ষ ঋণখেলাপিদের সম্পদ জব্ধ করার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। একইসাথে তাদের বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করার কথা বলছেন তারা। অন্যথায় ব্যাংক খাত কখনোই ঠিক হবে না। তারা বলছেন, কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ ভাঙা ছাড়া ব্যাংক খাতে খুব বেশি পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে শীর্ষ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যদিও লাফিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণের অঙ্ক, যা বর্তমানে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।’
আমরা মনে করি সময়োপযোগী এ প্রতিবেদনটিতে অনেক সারবত্তা রয়েছে। আর তাই এ বিষয়ে সরকারের গুরুত্ব দেয়া উচিত। জুলাই বিপ্লবের এক বছর পূর্ণ হতে আর অল্প সময় বাকি। জাতীয় নির্বাচনও সামনে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে অর্থনীতিকে শক্ত ভিত দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, খেলাপি ঋণ উদ্ধার করতে না পারলে ব্যাংক খাত ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে যাবে। যারা এসব ঋণ নিয়েছে প্রয়োজনে তাদের অ্যাসেট বিক্রি করে হলেও টাকা আদায় করতে হবে। আর যে টাকা পাচার হয়েছে আন্তর্জাতিক আইনের আশ্রয় নিয়ে সে টাকা উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, ইতোপূর্বে যারা এসব টাকা নিয়েছে তারা ফেরত দেওয়ার জন্য নেয়নি। তারা এটা ভোগ বা আত্মসাৎ করার জন্য নিয়েছে। আগে কখনও পাচার হওয়া টাকা উদ্ধার হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত নেই। তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংককে চেষ্টা করতে হবে। এসবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমরা মনে করি তাদের এ পরামর্শ সঠিক পরামর্শ। দেশের লাইফ লাইন অর্থনীতিকে বাঁচাতে যা যা করা দরকার বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগকে এ ব্যাপাওে সচেতন হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। জানা যায়, মার্চ প্রান্তিক শেষে বিরূপ মানে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ যে এভাবে লাফিয়ে বাড়বে, তা আগেই ধারণা দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। গত আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পরই তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ অনেক বাড়বে। আগের সেকথা স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। কোনো তথ্য লুকিয়ে রাখা হবে না। তবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর এটা আবার কমবে। এছাড়া নতুন করে বিতরণ করা ঋণ যেন খেলাপি না হয়, সেজন্য বিভিন্ন আইনি কঠোরতা আনা হচ্ছে। আমরা গবর্ণরের কথায় আশ্বস্ত হতে চাই। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের কথার সাথে একমত পোষণ করে বলতে চাই খেলাপি ঋণের বড় একটা অংশ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে, তা ফেরত আনতে পদক্ষেপ নিতে হবে। যে টাকা পাচার হয়েছে আন্তর্জাতিক আইনের আশ্রয় নিয়ে এ টাকা উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে হবে এবং শীর্ষ ঋণখেলাপিদের সম্পদ জব্ধ করার ব্যবস্থাও নিতে হবে।