কূটনৈতিক ভাষার প্রতি মানুষের আস্থা নেই। এ ভাষা শুনতে শুনতে মানুষ এখন তিক্তবিরক্ত। শুক্রবার ভোরে ইরানের ওপর নৃশংস হামলা চালালো ইসরাইল। এরপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখে আবার কূটনীতির সে বিরক্তিকর ভাষা। যে ভাষায় প্রায়ই সত্যকে আড়াল করা হয়। তবে এখন স্পষ্ট হতে শুরু করেছে যে, আমেরিকার সমর্থনেই ইরানে ইসরাইল হামলা করেছে। ইসরাইলি হামলায় শীর্ষস্থানীয় ইরানি সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীসহ ৭৮ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৩২০ জন। এর বিপরীতে রাতে ইসরাইলকে লক্ষ্য করে মিসাইল ও ড্রোন হামলা চারিয়েছে ইরান। এতে চারজন নিহত ও ৭০ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ইসরাইলি সংবাদ মাধ্যম। এদিকে সংবাদ মাধ্যম মিডল ইস্ট আইয়ের শুক্রবারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ইরানে ইসরাইলি হামলার আগেই আমেরিকা-ইসরাইলকে গোপনে বিপুল পরিমাণ হেলফায়ার মিসাইল সরবরাহ করেছে। হামলার আগে মঙ্গলবার ইসরাইলে ৩০০ হেলফায়ার মিসাইলের একটি চালান সরবরাহ করে ওয়াশিংটন। ইরানে ইসরাইলের হামলার পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত হয়েই এ বিশাল অস্ত্রের সরবরাহ তেলআবিবে পাঠানো হয়েছে বলে মিডল ইস্টআইকে জানান দু’মার্কিন কর্মকর্তা, তবে তাদের নাম প্রকাশ না করার শর্তে। হেলফায়ার মিসাইল লেসারে নির্দেশিত আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য বিশেষ ক্ষেপণাস্ত্র। নিখুঁত হামলার জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। ইসরাইলি বিমান বাহিনীর একশ’র বেশি যুদ্ধবিমান শুক্রবার ইরানে হামলা চালায়। সুনির্দিষ্ট হামলার জন্য যুদ্ধবিমানগুলো আমেরিকার সরবরাহ করা হেলফায়ার মিসাইল ব্যবহার করে।

আমেরিকার সমর্থনেই যে ইসরাইল ইরানে হামলা করেছে, তা এখন একটি স্পষ্ট বিষয়। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডেনাল্ড ট্রাম্প বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইরানে হামলার বিষয়ে তথ্য তার আগে থেকেই জানা ছিল। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমরা সবকিছুই জানতাম। আমি ইরানকে লজ্জা ও মৃত্যু থেকে রক্ষাও করতে চেয়েছিলাম। তাদের বাঁচানোর কঠিন চেষ্টা করেছি। কেননা আমার চেষ্টা ছিল যাতে একটি চুক্তি হয়।’ ট্রাম্পের উচ্চারিত শব্দমালা থেকে উপলব্ধি করা যায় তিনি এখন অহংকারের চূড়ায় অবস্থান করছেন। এমন অবস্থান থেকে সঠিক চিন্তা করা যায় না, সঠিক সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা যায় না। এ জন্যই বলা হয় অহংকার পতনের মূল। পতনের পর হয়তো ভুল উপলব্ধি করতে পারবেন, আফসোসও করবেন। ততদিনে অনেক বিলম্ব হয়ে যাবে। আমেরিকা তো একটি রাষ্ট্র, পৃথিবীর ইতিহাসে রোম সাম্রাজ্য, পারস্য সাম্রাজ্যের মত বড় বড় বিষয় ছিল। তাদেরও পতন ঘটেছে অহংকারের কারণে। আর বিস্ময়ের বিষয় হলো, কারো সাথে চুক্তি না করলেই কি হামলার শিকার হতে হবে? যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্রের কি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব থাকতে নেই? এ কোন বিশ্বব্যবস্থায় আমাদের বসবাস?

ইরানে ইসরাইলের হামলার পর তেলআবিবের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থনের ব্যাপারে বিভক্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে খোদ ট্রাম্প শিবিরেই। ট্রাম্প সমর্থকদের অনেকেই বলছেন, ইসরাইলকে লাগামহীন সমর্থন ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শুক্রবার ইরানে ইসরাইলের হামলার পর ট্রাম্প সমর্থকদের মধ্য থেকেই বলা হচ্ছে, আমেরিকার জন্য লাভজনক নয়, এমন কোনো সংঘাতে যাতে ওয়াশিংটন না জড়ায়। এদিকে ট্রাম্প সমর্থক মার্কিন রাজনৈতিক ভাষ্যকার টাকার কার্লসন বলেন, যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহুর কোনো সংঘাতে আমেরিকার সমর্থন দেওয়া উচিত হবে না। শুক্রবার নিজের ‘টাকার কার্লসন নেটওয়ার্কের’ সকালের নিউজলেটারে তিনি বলেন, ‘যদি ইসরাইল যুদ্ধ করতে চায়, তবে তা করার স্বাধীনতা তার আছে। সার্বভৌম দেশ হিসেবে সেটি সে করতেই পারে, তবে আমেরিকার সহায়তায় নয়।’ ট্রাম্প শিবির থেকেই এখন বলা হচ্ছে, ইসরাইলকে লাগামহীন সমর্থন ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বলা হচ্ছে, যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহুর কোনো সংঘাতে আমেরিকার সমর্থন দেওয়া উচিত হবে না। কিন্তু ট্রাম্প তো যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহুকে সমর্থন দিয়ে ফেলেছেন। এখন তিনি কী করবেন? সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হলে ট্রাম্পকে এখন অহংকারের চূড়া থেকে নামতে হবে, মাটিতে পা রাখতে হবে। মাটির মানুষকে তো মাটিতেই পা রাখতে হয় আখেরে। না হলে তো সে প্রবাদ ‘অহংকারে পতন’।