‘বেঁচে থাকলে আজ ওরা পরীক্ষা দিত’-হৃদয় স্পর্শ করার মতো শিরোনাম। ওরা মানে ছয়জন। জুলাই অভ্যুত্থানে এ ছয়জন শহীদ হয়েছেন। বেঁচে থাকলে এবারের অর্থাৎ ২৬ জুনের এইচ.এস.সি পরীক্ষায় ওরা অংশ নিত। এ ছয়জন হলো-আবদুল্লাহ বিন জাহিদ, মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া, আফিকুল ইসলাম সাদ, শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ, মারুফ হোসেন এবং আব্দুল আহাদ সৈকত। আবদুল্লাহ বিন জাহিদ শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছিল। বাবা জাহিদুল ইসলাম ও মা ফাতেমা তুজ জোহরার দু’ সন্তানের মধ্যে বড় ছিল জাহিদ। ছেলের মৃত্যুর পর একের পর এক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন মা ফাতেমা। বড় ছেলের মৃত্যুর ১৪ দিনের মাথায় ছোট ছেলে মাহমুদুল্লাহ বিন জিসানের (১৪) কোলন ক্যানসার ধরা পড়ে। গত ১৮ মার্চ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে স্বামী মারা যান। জিসানকে নিয়ে তিনি এখন রাজধানীর উত্তরার আব্দুল্লাহপুরে থাকেন। ফাতেমা জানান, ৫ আগস্ট রাতে রাজধানীর উত্তরায় এপিবিএন সদর দফতরের উল্টো পাশে গলা ও পিঠে গুলিবিদ্ধ হয় আবদুল্লাহ। তখন তারা আশকোনায় থাকতেন। ফাতেমা বলেন, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসার পর থেকে সারাক্ষণই তার মনে ভাসতে থাকে, ছেলেটারও পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানে কলেজ থেকে তাকে ডেকেছিল। অনেক কষ্ট লাগবে বলে যাননি। তিনি বলেন, ‘ওর পাঁচ বন্ধু লাসিম, হাসান, সালেহীন, রাকিব ও মেহেদিকেও নিজের সান্তানদের মতো ‘বাবা’ বলে ডেকেছি। ওরা মঙ্গলবার ফোনে অনেক কান্নাকাটি করেছে। দোয়া চেয়েছে। ছেলে নেই, ওর বন্ধুদের জন্য দোয়া রইলো আমার।’

মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়ার ডাক নাম ছিল ফাইয়াজ। বন্ধুরা ডাকতো পারহান নামে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘ফারহান ফাইয়াজ’ নামে অ্যাকাউন্ট খুলেছিল ফাইয়াজ। ফেসবুকের সে নামটিই এখন জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রতীক। ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিল ফারহান ফাইয়াজ। শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া ও ফারহানা দিবা দম্পতির দু’ সন্তানের মধ্যে সে ছিল বড়। ছোট বোন সায়ীমা ইসলাম এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। বাবা শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে ঢাকায় প্রথম শহীদ ফারহান। ১৮ জুলাই আন্দোলনের সময় ফারহানের বুকে টার্গেট করে গুলি করা হয়। বেলা সোয়া দুইটায় মৃত্যু হয় তার। তিনি বলেন, ‘ছেলেটা গাবেষক হতে চেয়েছিল। বিদেশে গিয়ে ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে গবেষণা করার আকাক্সক্ষা ছিল তা।’

শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ (১৭) মিরপুর ১০ নম্বরে আন্দোলনে থাকার সময় ৪ আগস্ট পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়। সে স্কাউটিং করতো। দুঃসাহসিক ও গৌরবময় সেবার স্বীকৃতি হিসেবে মঙ্গলবার বাংলাদেশ স্কাউটসের পক্ষ থেকে আরো কয়েকজনের সঙ্গে ‘গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হয় আহনাফকে। প্রধান উপদেষ্টা তার কার্যালয়ে আহনাফের মায়ের হাতে এ পুরস্কার তুলে দেন। পূর্ব বাড্ডার বাসিন্দা মো. ইদ্রিস বলেন, তার তিন ছেলের মধ্যে মারুফ ছিল বড়। সে বরিশালের একতা ডিগ্রী কলেজ থেকে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জুলাই আন্দোলন জোরদার হওয়ার পর মারুফ ঢাকায় চলে আসে। এক সপ্তাহ পর ১৯ জুলাই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে নাভির নিচে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয় মারুফ। মো. আব্দুল আহাদ সৈকত (১৭) বেঁচে থাকলে ঢাকা কমার্স কলেজ বিজ্ঞান বিভাগ থকে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিত। দুই ভাই-বোনের মধ্যে সৈকত ছিল ছোট। বাবা নজরুল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে তিনি ও ছেলে যোগ দিয়েছিলেন। পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে স্রোতের মত মিছিল আসতে থাকলে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে এনাম মেডিকেল কলেজের সামনে পুলিশের গুলিতে শাহীদ হয় সৈকত।

বাবা নজরুল ইসলাম বলেন, মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে এক ঘন্টা বেঁচে ছিল সৈকত। সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল আফিকুল ইসলাম সাদেক (১৮)। ৫ আগস্ট ধামরাইয়ে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হয় সাদ। পরে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতলের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শহীদ হয় সাদ ৮ আগস্ট। ৪ আগস্ট সাদ তার ফেসবুকে লিখেছিল, ‘যে দেশের ইতিহাস রক্ত দিয়ে শুরু হয়েছে, ওই ইতিহাস আবার লিখতে রক্তই লাগবে।’ আর ফারহান ফাইয়াজ মৃত্যুর আগে ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছিল, ‘একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ তোমাকে মনে রাখে।’ তরুণরা শহীদ হয়ে উদাহরণ রেখে গেল জাতির সামনে। কিন্তু জাতির যারা নেতা তারা জুলাই বিপ্লবের ঘটনা এবং বার্তা কতটা মনে রেখেছেন? এখন দেশের রাজনীতির যে চেহারা, সে জন্যই কি তরুণরা প্রাণ দিয়েছে? এ প্রশ্নের জবাব প্রয়োজন। তরুণরা তো স্বপ্ন দেখেছিলো, দেশের জনগণের অধিকারের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতিই যেন আবার উঁকি দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে প্রয়োজন কঠোর প্রতিরোধ।