সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা গত সোমবার শেষ হয়েছে। বৈঠক শেষে জাতীয় এ আলোচনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা যায়- দু’মাস আগে শুরু হওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রথম পর্যায়ের আলোচনার সমাপ্তি ঘটেছে। এ পর্যায়ের আলোচনা বিশ্লেষণ করে খুব শীঘ্রই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু হবে। যেসব বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে সেগুলো নিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা হবে। পবিত্র ঈদুল আজহার আগেই (জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে) দ্বিতীয় পর্যায়ের এ আলোচনা শুরু হতে পারে। এরপর দলগুলোর সাথে আলোচনা সাপেক্ষে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ তৈরি করা হবে। আগামী জুলাই মাসেই এ সনদ তৈরির চূড়ান্ত লক্ষ্য রয়েছে ঐকমত্য কমিশনের।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বারবার এক বিষয় পরিষ্কার হয়েছে- একদলীয় শাসনব্যবস্থা কখনোই দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রের শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং জনগণের আস্থার ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে না। বারবার নির্বাচনের পূর্বে ও পরবর্তী সময়ে সহিংসতা, পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের নিরপক্ষেতা নিয়ে বিতর্ক এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা প্রমাণ করেছে যে, একটি সর্বদলীয় জাতীয় ঐকমত্যের বিকল্প নেই। জুলাই বিপ্লবের পরে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের উদ্যোগ সময়োপযোগী এবং এর সফলতা নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট সকল রাজনৈতিক শক্তির আন্তরিকতা, উদারতা ও ঐকান্তিক ইচ্ছাশক্তির ওপর। এ কমিশন গঠনের মূল উদ্দেশ্য কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্র সৃষ্টি করা নয়, বরং একটি কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী সমঝোতার ভিত্তি রচনা করা, যা ভবিষ্যতের রাজনীতিতে ন্যূনতম শালীনতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও নৈতিক মান নিশ্চিত করবে।

আমরা এমন একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা প্রত্যাশা করি যেখানে সকল দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, প্রশাসন থাকবে নিরপেক্ষ ও পেশাদার, বিরোধী দল পার্লামেন্টে সম্মানজনক অবস্থান পাবে ও নীতিনির্ধারণী আলোচনায় সক্রিয় থাকবে, বিচার বিভাগ এবং গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে এবং সর্বোপরি যেখানে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে দলীয় নয় জাতীয় স্বার্থই হবে মুখ্য বিবেচ্য।

এ লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন একটি সর্বদলীয় ‘জাতীয় সনদ’, যা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরিত একটি মৌলিক দলিল। এ সনদে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারেÑসংবিধান ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি, ক্ষমতা হস্তান্তরের রূপরেখা, মানবাধিকার রক্ষার মৌলিক শর্ত, নির্বাচনী প্রক্রিয়া সংস্কারের রূপরেখা এবং রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সহাবস্থানের মৌলিক নীতিমালা। বছরের পর বছর সংঘাতময় রাজনীতি, ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্ব এবং অস্থিতিশীল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ভিকটিম হতে হতে দেশের মানুষ এখন ক্লান্ত। তারা চায় একটি ভবিষ্যৎ যেখানে স্থায়ী নীতিমালা ও পরিকল্পনার ভিত্তিতে দেশ পরিচালিত হবে। দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পররাষ্ট্রনীতি যেন রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে দোদুল্যমান না হয়। জাতীয় সনদ সে কাঠামো তৈরি করতে পারে যা রাষ্ট্রকে দীর্ঘমেয়াদে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাবে।

এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলোÑ নিজেদের দলীয় অবস্থান থেকে বৃহত্তর জাতীয় অবস্থানে উত্তরণ। এটা সত্য, প্রতিটি রাজনৈতিক দলই কিছু কিছু ইস্যুতে পার্থক্য বজায় রাখবে; এটি গণতন্ত্রেরও সৌন্দর্য। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার ন্যূনতম মূলনীতি, নির্বাচন, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা এবং নাগরিক অধিকার সংরক্ষণে সকল দলের সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি থাকতেই হবে। ঐকমত্য কমিশন যদি বাস্তবসম্মত সময়সূচির মধ্যে দলগুলোর মতামত গ্রহণ করে একটি খসড়া সনদ প্রণয়ন করে এবং তা যদি রাষ্ট্র গ্রহণ করে নেয় তাহলে এ সনদটি হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য নজির।

এ ক্ষেত্রে মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পেশাজীবী সংগঠন ও নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। তাদের মতামত এই প্রক্রিয়াকে গণমুখী ও বিশ্বাসযোগ্য করবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সহযোগী রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেও এটা প্রমাণ করবে যে বাংলাদেশ এক দায়িত্বশীল, পরিণত গণতন্ত্রের পথে এগোচ্ছে। আমরা দেখতে চাই, রাজনৈতিক নেতারা অতীতের রেষারেষি ভুলে সামনে তাকাবেন। তারা বুঝবেনÑসংঘাত নয়, সংলাপই সমাধান। বিভাজন নয়, বিভক্তির রাজনীতিও নয়; বরং ঐক্যই হবে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের ভিত্তি।