খবরটি উদ্বেগজনক হলেও অপ্রত্যাশিত নয়। এশিয়ার ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০২১ সালে এটা ছিল ৮ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ছিল ৮দশমিক ৭ শতাংশ। ভুটানের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণের হার ছিল ২০২০ সালে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ,যা ২০২২ সালে ৩ শতাংশে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। ২০২০ সালে ভারতের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণের হার ছিল ৭ দশমিক ৯শতাংশ,যা ২০২৩ সালে ১ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। একই সময়ে মালদ্বীপের খেলাপি ঋণের হার ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমে ৮দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ান দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ ছিল কিরগিস্থানের। ২০২২ সালে দেশটির খেলাপি ঋণের হার ছিল ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে ৮ দশমিক ৯শতাংশে নেমে আসে। দক্ষিণ এশিয়ান দেশগুলোর মধ্যে তাইপে এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে কম, যথাক্রমে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ২ শতাংশ।
দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশই তাদের ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এবং হার কমিয়ে আনতে পারলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র মতে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর কোয়ার্টারে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের হার ছিল ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০২৫ সালের জুন মাসে খেলাপি ঋণের হার ছাড়কৃত ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ হচ্ছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর ছাড়কৃত ঋণের এক-চতুর্থাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতাসীন হয় তখন দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মোট ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের কারণে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর বর্তমানে বিনিয়োগযোগ্য তারল্যের সঙ্কটে ভুগছে। অধিকাংশ ব্যাংকই উদ্যোক্তাদের প্রত্যাশা মতো ঋণ দিতে পারছে না।
অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংক সংশ্লিষ্টগণ মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে পরিসংখ্যান প্রদর্শন করছে তা বাস্তব অবস্থার প্রতিফলক নয়। বাস্তবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো অনেক বেশি। বিগত সরকার আমলে একটি প্রভাবশালি উদ্যোক্তা গোষ্ঠীর চাপে পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ হিসাব শ্রেণিকরণ নীতিমালা বারবার পরিবর্তন করেছে। বিদ্যমান আন্তর্জাতিক মানের আইনগুলো এমনভাবে পরিবর্তন এবং পরিমার্জন করা হয়েছে যাতে খেলাপি ঋণের কিস্তি আদায় না করেও ঋণ হিসাবকে ক্লিন দেখানো যায়। ঋণ হিসাব অবলোপন নীতিমালা, ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ নীতিমালা সহজীকরণের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আড়াল করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে যদি ঋণ হিসাব শ্রেণিকরণ করা হয় তাহলে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করে যেতে পারে। বিগত সরকার আমলে লুটপাট ও অর্থ পাচারের একটি বড় মাধ্যম ছিল ব্যাংকিং খাত। নানা অছিলায় ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অর্থ বের করে নিয়ে তা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা এবং বিদেশে পাচার করা ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ক্লিন দেখানোর জন্য বিদ্যমান আন্তর্জাতিক মানের আইনগুলোকে পরিবর্তনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণকে আড়াল করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে যে শ্বেতপত্র কমিটি গঠন করা হয়েছিল তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিগত সরকার আমলে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে মোট ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমতুল্য ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। পাচারকৃত এ অর্থের বেশির ভাগই ব্যাংকিং চ্যানেল দিয়ে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। আবুল মাল আব্দুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকাকালে রাজনৈতিক বিবেচনায় ৯টি ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়। সে সময় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, দেশে নতুন ব্যাংকের কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু তারপরও রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হলো। বাংলাদেশে বর্তমানে ৬২টি ব্যাংক ব্যবসায়রত আছে। অথচ ভারতের মতো বিশাল দেশেও ব্যাংকের সংখ্যা ৩০টির কম। ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হয়ে যাবার কারণে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভুতকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ব্যাংক একীভুত করা হলে সমস্যা না কমে বরং আরো বেড়ে যেতে পারে। তারচেয়ে ব্যাংকগুলোকে একটি নির্দিষ্ট সময় দিয়ে তাদের অবস্থা ভালো করার জন্য পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। যেসব ব্যাংক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাদের অবস্থা ভালো করতে পারবে না তাদের অবলুপ্ত করে দেয়াই হবে যুক্তি সঙ্গত।