ঘৃণা, বিদ্বেষ, মানুষের কাক্সিক্ষত বিষয় নয়। কারণ, এসব দোষ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সমূহ ক্ষতি ডেকে আনে। তারপরও পৃথিবীতে ঘৃণা ও বিদ্বেষের মাত্রা বেড়েই চলেছে। ফলে প্রশ্ন জাগে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সভ্যতায় বাস করেও মানুষ কি নীতি ও মননের দিক থেকে দরিদ্র হয়ে পড়েছে? এ জন্যই হয়তো বড় বড় দেশের মন্ত্রীদের কন্ঠেও আজকাল শোনা যাচ্ছে অশ্লীল কটূক্তি। প্রসঙ্গত ভারতের কথা উল্লেখ করা যায় এখানে। ১৫ মে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের মুসলিমদের প্রতি বিজেপি তথা মোদি সরকারের চরম ঘৃণা আর বিদ্বেষের জ¦লন্ত প্রমাণ আবারও সামনে এলো। মোদি তার ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্য সংখ্যালঘু কার্ড ব্যবহার করে অপারেশন সিঁদুরের ব্যাপারে যে মুসলিম নারী সেনা কর্মকর্তাকে দিয়ে নিয়মিত ব্রিফ করিয়েছেন, সে কর্ণেল সোফিয়া কুরেশিই এখন বিজেপির টার্গেট। এ ভারতীয় মুসলিম নারী সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে বিজেপির মন্ত্রী বিজয় শাহ অশ্লীল কটূক্তি করেছেন। কর্ণেল সোফিয়াকে সন্ত্রাসীদের বোন আখ্যা দিয়ে মধ্যপ্রদেশের উপজাতি কল্যাণমন্ত্রী বিজয় শাহ বলেছেন, আমাদের হিন্দু ভাইদের যেসব সন্ত্রাসীরা বিবস্ত্র করে পেহেলগামে হত্যা করেছিল, মোদিজি সেসব সন্ত্রাসীদেরই এক বোনকে পাঠিয়ে ওদের উলঙ্গ করে শিক্ষা দিয়েছেন। বিজেপি মন্ত্রীর এমন মুসলিম বিদ্বেষী কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমত ভাইরাল। তার এ বক্তব্যকে কট্টরপন্থী অনেক হিন্দু সমর্থন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টও দিচ্ছেন। তবে কংগ্রেসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, ইউটিউবার ও সাংবাদিকসহ অনেকেই এর তীব্র সমালোচনা করছেন। তারা এ বক্তব্যের ব্যাপারে সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার পাশাপাশি বিজয় শাহকে মন্ত্রীর পদ থেকে বহিষ্কারের দাবিও তুলেছেন।
মধ্যপ্রদেশের এ উগ্র হিন্দুত্ববাদী মন্ত্রী গত মঙ্গলবার রামকুণ্ডা অঞ্চলে এক জনসভায় এমন অশ্লীল ও বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। ওই বক্তব্য প্রকাশ্যে আসার পরপরই শুরু হয় সমালোচনা। কংগ্রেসের মধ্যপ্রদেশের সভাপতি জিতু পাতওয়ারি বিষয়টি নিয়ে তার এক হ্যাণ্ডেলে ভিডিও শেয়ার করে বলেছেন, বিজেপি মন্ত্রীর এমন নিচু মানসিকতাকে কি দল সমর্থন করে? সর্বভারতীয় কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বিজয় শাহের মন্তব্যকে অত্যন্ত অপমানজনক, লজ্জাজনক ও অশালীন বলে আখ্যা দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা দুঃখের সঙ্গে দেখছি, অপারেশন সিঁদুর নিয়ে নৌবাহিনীর শহীদ কর্মকর্তার স্ত্রীকে ট্রল করা হয়েছে। এরপর পররাষ্ট্র সচিবের মেয়েকে করা হয়েছে হয়রানি। আর এখন সেনাকর্মকর্তা সোফিয়া কুরেশিকে নিয়ে বিজেপি মন্ত্রীর এ ঘৃণিত মন্তব্য। এটাই বিজেপিÑআরএসএসের মানসিকতা। শুভংকর মিশ্র নামে এক সাংবাদিক তার ইউটিউব চ্যানেলে নরেন্দ্রমোদির তীব্র সমালোচনা করে বলেন, লজ্জা-লজ্জা-লজ্জা, মোদির লজ্জা। আপনার দলের নেতার বক্তব্য এখন সারা বিশ্বে প্রচার হচ্ছে। পাকিস্তানি মিডিয়াগুলো ফলাও করে প্রচার করছে এ বক্তব্য। বিশ্বে ভারত সম্পর্কে কী বার্তা যাচ্ছে তা কি একবার ভেবে দেখছেন? কী ধরনের ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে আপনার দলের মাধ্যমে, তা ভেবে দেখুন। মুসলিমরা ভারতে প্রতিনিয়ত টার্গেটে পরিণত হয়-এ বয়ানকে সত্যি করতে চাচ্ছেন? সোফিয়া একজন মুসলিম, সে জন্যই তার সঙ্গে এ অপমানজনক আচরণ? মোদিজি আপনি যদি দেশপ্রেমিক হয়ে থাকেন; তাহলে বিজয় শাহের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। আর ব্যবস্থা না নিলে ধরে নেব আপনি দেশ নিয়ে ভাবেন না।
আরেক সাংবাদিক সংকেত উপাধ্যায় বলেছেন, দেশের মধ্যে যখন ঐক্য প্রয়োজন, ঠিক তখনই মানুষের মনে বিষ ঢেলে দেওয়া হয়েছে। বিজয় শাহ তার নেতার প্রশংসা করতে গিয়ে সেনাবাহিনীকে অপমান করেছেন। বিজয় শাহ তো আটবারের বিধায়ক। দীর্ঘদিন ধরে তিনি মন্ত্রী। সুতরাং তার বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। মোদি সরকার তার ব্যাপারে কেন চুপ-এ প্রশ্ন এখন সবার। এবিপি গঙ্গা লাইভ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলে বিজয় শাহের বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে বলা হয়, এ নেতা যা বলেছেন, তা তার উপরের নেতাদের কাছ থেকেই শিখেছেন। মুসলিমদের প্রতি তাদের ঘৃণারই প্রতিফলন এ বক্তব্য। সোফিয়া কোনো সন্ত্রাসীর বোন নন। সোফিয়া আমাদের সবার বোন হিসেবেই থাকবেন। অবাক ব্যাপারে হলো, এতসব প্রতিবাদের পরও বিজয় শাহ তার বক্তব্য প্রত্যাহার করেননি, দুঃখ প্রকাশও করেননি। উপলব্ধি করা যায়, ভারতের সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনার সাথে মোদি সরকার, বিজেপি এবং উগ্র হিন্দুদের ভাবনার তেমন মিল নেই। এরাতো ঘৃণা-বিদ্বেষের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। এমন পরিবেশকে তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য অনুকূল মনে করে থাকেন। ফলে তাদের আমলে দেশের ভেতর লক্ষ্য করা যাচ্ছে সাম্প্রদায়িক হিংসা-বিদ্বেষ, আর সীমান্তে সংঘর্ষ। নেই শান্তির বাতাবরণ। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, স্বাভাবিক ও যৌক্তিক আচরণের মধ্যেই রয়েছে রাষ্ট্রের সংহতি ও সমৃদ্ধি। মোদি সরকার তা উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।