জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন, ২০২৫-এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। বিগত তিনটি নির্বাচনে যে সকল অনিয়ম করা হয়েছে তা দূর করতে এ পরিবর্তন জরুরী ছিল। আরপিওতে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ইভিএম ব্যবহার বাতিল, ‘না ভোট’ পুনর্বহাল, প্রার্থীদের দেশি-বিদেশি আয় ও সম্পত্তির বিবরণ প্রকাশের বাধ্যবাধকতা এবং পলাতক আসামীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা।

গতকাল দৈনিক সংগ্রামে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে কোনো পলাতক আসামী প্রার্থী হতে পারবে না এমন বিধান সংবলিত সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় আরপিও সংশোধনের অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সভায় সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকের পর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি জানান, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ২০২৫ চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়েছে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় আইন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর আইন নীতিগতভাবে অনুমোদন পেয়েছে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, আরপিওতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী হলো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) সংক্রান্ত বিধান বাতিল করা। পাশাপাশি ‘না ভোট’ পুনর্বহাল করা হয়েছে, যাতে কোনো নির্বাচনী আসনে কেবল একজন প্রার্থী থাকলে ভোটাররা তাকে ভোট না দেওয়ার সুযোগ পান। তিনি আরো বলেন, ২০১৪ সালের সাজানো নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতেই এই বিধান আনা হয়েছে। একজন প্রার্থী থাকলে ভোটাররা যদি তাকে পছন্দ না করেন, ‘না ভোট’ দিতে পারবেন। তখন সে আসনে পুনরায় নির্বাচন হবে।

নতুন সংশোধনীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পলাতক আসামীরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। জেলাভিত্তিক নির্বাচন অফিসগুলোতে দায়িত্ব পালন করবেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। প্রার্থীদের দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে আয় ও সম্পত্তির বিবরণ হলফনামায় দিতে হবে, যা নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে উন্মুক্তভাবে প্রকাশ করা হবে। আইন উপদেষ্টা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন, নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রত্যেক প্রার্থীর দেশি-বিদেশি আয় ও সম্পত্তির পূর্ণ বিবরণ নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। জনগণ যেন সহজেই জানতে পারেন তাদের প্রার্থীর আর্থিক অবস্থা কী।

সংশোধনীর মধ্যে আরো রয়েছে, নির্বাচনী জামানতের পরিমাণ ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলকে ৫০ হাজার টাকার বেশি অনুদান বা চাঁদা দিতে হলে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার বাধ্যতামূলক এবং অনুদানদাতার ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে হবে। বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী ভোটার ও নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তারা ডাক ভোটে ভোট দিতে পারবেন। ভোট গণনার সময় গণমাধ্যমের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে। কোনো নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক অনিয়ম হলে পুরো এলাকার ভোট বাতিল করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। আইন উপদেষ্টা জানান, জোটের প্রার্থীদের প্রতীক ব্যবহারে স্বচ্ছতা আনতে বিধান যোগ করা হয়েছে, যাতে ভোটাররা সহজেই বুঝতে পারেন কোন দল থেকে প্রার্থী হচ্ছেন। আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ক্ষেত্রে যে ইম্পর্টেন্ট অ্যামেন্ডমেন্ট করা হয়েছে। ইভিএম সংক্রান্ত বিধান বিলুপ্ত করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতায় পলাতক ব্যক্তিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার বিধান যুক্ত করা হয়েছে।’ এসব সিদ্ধান্ত নির্বাচনে ইতিবাচক বিবেচিত হবে বলে আমরা মনে করি। ইভিএমের মাধ্যমে ভোট চুরির পথ রহিত হবে বলেও আমরা মনে করি।

আমরা মনে করি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার বিতর্কিত ইভিএম বাতিলসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে জনদাবির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। এছাড়া বিগত স্বৈরাচারী আমলে যারা হত্যা নির্যাতন করে মামলায় জড়িত ও পলাতক রয়েছে তাদেরও নির্বাচনে অংশ গ্রহণের বিধান রহিত করে জনদাবির প্রতি সম্মান জানানো হয়েছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত ও ফ্যাসিস্ট শক্তির দোসরদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগও রহিত করার মাধ্যমে আসন্ন নির্বাচনে প্রকৃত গণতান্ত্রিক দলগুলোর জন্য সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আমরা মনে করি। আমরা ইভিএম বাতিলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই, সেই সাথে গৃহীত সকল সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই।