অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ২ জুন বিকেলে টিভি চ্যানেলে ভাষণের মাধ্যমে ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার এক বাজেট পেশ করেছেন। বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই- আগস্ট মাসের বিপ্লব পরবর্তী রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ছিল সাধারণ মানুষের জন্য এক বিশেষ প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দু। রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তনের যে ঢেউ দেশজুড়ে বয়ে গিয়েছিল, তার প্রতিফলন জনগণ চেয়েছিল অর্থনৈতিক নীতিমালায়Ñবিশেষ করে বাজেটে। কিন্তু সদ্য ঘোষিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এ বাজেট তাৎপর্যপূর্ণ কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন বা বৈপ্লবিক অর্থনৈতিক রূপান্তরের বার্তা দেয়নি। এটি এক অর্থে একটি ধারাবাহিক, রক্ষণশীল ও ট্রেডিশনাল বাজেট, যেখানে অতীতের ধাঁচেই খরচ, রাজস্ব আহরণ ও ব্যয়ের ছক কষা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটের সাথে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের মূল বাজেটের মোটা দাগে খুব একটা তফাৎ পরিলক্ষিত হয়নি। এবার বাজেটে ব্যয় না বাড়লেও তেমন কোন ব্যয় কমেওনি। এতে কোন নতুনত্বের ছোঁয়াও পরিলক্ষিত হয়নি। ঘোষিত বাজেটে বড় অংকের ব্যয় মেটাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। গত অর্থবছরেও এর কাছাকাছি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। ফলে রাজস্ব আদায়ের এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা বড়ো ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিতে পারে।
বাজেটে জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা প্রদান, সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধি এবং আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা প্রশংসার দাবি রাখে। তবে বরাদ্দকৃত অর্থ যথেষ্ট নয়; এ পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আহতদের সুচিকিৎসাকে অগ্রাধিকার পাওয়া দরকার। বিদেশে পাচারকৃত অর্থ এবং অন্যান্য অবৈধ অর্থ উদ্ধার করে ফিরিয়ে আনার স্পষ্ট কোন পরিকল্পনা বাজেটে লক্ষ্য করা যায়নি, যা জাতিকে হতাশ করবে। এছাড়াও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এ অপসংস্কৃতিটি ফ্যাসিবাদী সরকারের সময়ে ছিল, এই সরকারের আমলে জনগণ এ ধরনের কোনো অনাচার দেখতে চায় না।
এটা ঠিক যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে সময় সীমিত এবং তাদের সক্ষমতারও কমতি রয়েছে। তাই বাজেটে বড় ধরনের সংস্কার না থাকা এক অর্থে যৌক্তিকও হতে পারে। কিন্তু জনগণের একটি বড় অংশ মনে করেছিল, অন্তত কিছু সাহসী পদক্ষেপÑযেমন দুর্নীতিবিরোধী স্পষ্ট দিকনির্দেশনা, ধনীদের ওপর বাড়তি কর আরোপ, এবং জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারের নতুন ভাবমূর্তির ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। কিন্তু এসব প্রত্যাশা বাজেট বক্তৃতায় ম্লান হয়ে গেছে।
বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে কিছু বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এতবড় বাজেটে শিক্ষা সামগ্রীর দাম কমালেও শিক্ষা খাতে মোট বাজেট কমানো হয়েছে। স্বাস্থ্যখাতে উপকরণ, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, কৃষি কাজে ব্যবহৃত সার-কীটনাশকসহ অন্যান্য পণ্যের দাম কমানো হয়েছে যা আশাব্যঞ্জক। এছাড়াও কোল্ড স্টোরেজ খরচ কমানোর কারণে কৃষকদের জন্য কিছুটা স্বস্তির কারণ হবে। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা, ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ফেরানোর রূপরেখা, এবং আমদানি-নির্ভরতা কমিয়ে উৎপাদনমুখী অর্থনীতি গড়ার সুদৃঢ় সংকল্প বাজেটে পরিস্কার করা উচিত ছিল। এমনকি মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য স্বস্তি আনার মতো কর সংস্কারের কোনো কাঠামোও এখানে প্রনয়ন করা হয়নি।
বিশ্বমন্দার ছায়া, ডলারের চাপ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটÑএসব বাস্তবতা আমলে নিয়ে বাজেট নির্মাণ করাটা নিঃসন্দেহে কঠিন। তবে এ কঠিন সময়ে বৈচিত্র্যহীন বাজেট সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারছে না। বাজেট হওয়া উচিত ছিল রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অর্থনীতিতে একটি নতুন দিগন্তের সূচক। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। অন্তত কিছু প্রতীকী সাহসী সিদ্ধান্তÑযেমন আমলাতান্ত্রিক ব্যয়ের লাগাম টানা, কর ফাঁকি রোধে প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ, প্রবাসী আয়কে উৎসাহিত করতে প্রণোদনার পুনর্বিন্যাসÑএসব কিছু বাজেটে জায়গা পেলে জনগণ অন্তত একটি বার্তা পেত যে, পরিবর্তনের যাত্রা কেবল রাজনৈতিক নয়, অর্থনীতিতেও তার প্রতিফলন ঘটছে। আমরা আশা করি, সামনে যে সরকার দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় আসবে, তারা একটি অংশগ্রহণমূলক, জনবান্ধব ও সংস্কারভিত্তিক অর্থনৈতিক দর্শনের পথে এগোবে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক দিক থেকে ২০২৫-২৬ বাজেট স্থিতিশীলতারই বার্তা দিয়েছে, কিন্তু তা পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারেনি।