ঢাকার উত্তরা এলাকায় অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে যে মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিমান দুর্ঘটনার এক ভয়াবহতম ঘটনা হিসেবেই শুধু নয়Ñরাষ্ট্রের নাগরিক নিরাপত্তা, জবাবদিহি ও ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত কাঠামোর একটি নিষ্ঠুর ব্যর্থ উদাহরণ হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এটি নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়; বরং পূর্ব-প্রতিরোধযোগ্য এক অবহেলার ফল। একটি যুদ্ধবিমান দিনের বেলা শিক্ষার্থীদের ক্লাস বা পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে, রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় একটি স্কুল ভবনের ওপর বিধ্বস্ত হয়Ñএটা কেবল প্রযুক্তিগত ত্রুটি নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নজরদারির ঘাটতি, প্রশিক্ষণের ত্রুটি এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার অভাব।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে এ দুর্ঘটনায় ৩৪ জনের অধিক নিহত হয়েছেন যাদের প্রায় সবাই শিশু বয়সী শিক্ষার্থীÑতাদের অনেকের বয়স ১৪ বছরের নিচে। শিক্ষক, অভিভাবকসহ বহু মানুষ আহত হয়েছেন। যারা মারা গেছেন, তাদের জীবন যে অমূল্য, তা শুধু আবেগগত নয়, রাষ্ট্রনৈতিক বাস্তবতায়ও প্রতিটি নাগরিকের জীবন রক্ষা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। প্রসঙ্গত, এ ধরনের বেসামরিক প্রাণহানির ঘটনায় সারা বিশ্বে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকে সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো এরকম কোনো ক্ষতিপূরণ আইন বা ‘টর্ট আইন’ নামে কোনো স্বাধীন ও পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করা হয়নি, যা একজনের অবহেলা বা কৃতকর্মে অন্যের ক্ষতি হলে সংশ্লিষ্ট ভিকটিমের আর্থিক প্রতিকার নিশ্চিত করে। ফলে ক্ষতিপূরণের প্রশ্নে বাংলাদেশে এক ধরনের আইনি শূন্যতা বা অস্পষ্টতা দেখা যায়।

যদিও প্রচলিত ফৌজদারি বা দেওয়ানি আইনে মামলা করে কিছুটা প্রতিকার পাওয়া সম্ভব, তবুও সেখানে দীর্ঘসূত্রিতা ও জটিলতা এতটাই প্রবল যে অধিকাংশ নাগরিক প্রতিকার চাইতেই নিরুৎসাহ হন। তবে বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদন সূত্রে জানা যাচ্ছে যে, উচ্চ আদালতে জনস্বার্থে একটি রিট দায়ের হয়েছে, যেখানে নিহতদের পরিবারকে পাঁচ কোটি এবং আহতদের এক কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। একই রিটে ত্রুটিপূর্ণ বিমান জনবহুল এলাকায় উড্ডয়নের ওপর নিষেধাজ্ঞার দাবিও জানানো হয়েছে। এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা সম্ভব।

এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, সাধারণ নাগরিক নিহত হলে, বিশেষ করে রাষ্ট্র যন্ত্রের ব্যর্থতায়, ক্ষতিপূরণ বা বিচারপ্রক্রিয়া প্রায়শই ‘নেতিবাচক চুপ’ বা ‘প্রতীকী দুঃখ প্রকাশ’ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। অথচ মানবাধিকার, সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে এই ক্ষতিপূরণ দেওয়া বাধ্যতামূলক। মাইলস্টোনের এই মর্মান্তিক ট্রাজেডির দায় কার? পাইলট, টেকনিক্যাল টিম, উড্ডয়ন নিয়ন্ত্রণ, যুদ্ধবিমান রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিট, কিংবা বিমান বাহিনীর লজিস্টিক চেইন? দায় একক নয়, বহুমাত্রিক এবং প্রতিষ্ঠিত আইনি কাঠামোর মাধ্যমেই তা নির্ধারণ করা জরুরি। রুটিন তদন্ত নয়, পূর্ণাঙ্গ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির মাধ্যমে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হোক।

বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও প্রশাসনিক ত্রুটিতে জর্জরিত দেশে স্পষ্ট একটি ক্ষতিপূরণ আইন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। শুধু বিমান নয়, খোলা গর্তে পড়ে শিশু মৃত্যু, ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে প্রাণহানি, হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ড, লঞ্চডুবিÑএমন অজস্র ঘটনায় অসংখ্য মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের পথ প্রায়শই বন্ধ। ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য আইনী বাধ্যবাধকতা থাকলে তাতে শুধু ক্ষতিপূরণের অর্থনৈতিক প্রতিকারই নিশ্চিত হবে না বরং এটি ভবিষ্যতে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধমূলক কাঠামোও গড়ে তুলবে।

একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পারলে, উন্নয়ন, নিরাপত্তা বা প্রযুক্তির অগ্রগতির কোনো মূল্য থাকে না। মাইলস্টোনের ছাত্রদের প্রাণ চলে গেছে, যেন এক প্রতীক হয়ে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেÑরাষ্ট্রীয় অবহেলার ফল কত ভয়াবহ হতে পারে। এই ঘটনায় যেন ক্ষতিপূরণ কেবল অর্থে সীমাবদ্ধ না থাকেÑবরং রাষ্ট্রীয় নীতিমালা, সচেতনতা ও আইনি সংস্কারের মধ্য দিয়ে একটি মানবিক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা হোক।