জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশ সফরের বিষয়টি এবার বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। চারদিনব্যাপী সফরের তৃতীয় দিন বিকেলে রাজধানীর একটি হোটেলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো: তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, বাংলাদেশের সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের জনগণের পাশে থেকে একটি টেকসই ও ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে জাতিসংঘ নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে থাকবে। জাতিসংঘ মহাসচিব তাঁর সফরের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার এবং তৃতীয় দিন শনিবার ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন বাংলাদেশে। শুক্রবার তিনি ঢাকায় প্রথমে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর তিনি কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যান। সেখানে তিনি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং এক লাখ রোহিঙ্গার সাথে প্রধান উপদেষ্টা আয়োজিত ইফতারে অংশ নেন। তৃতীয় দিন শনিবার সকালে রাজধানীর গুলশানে ‘ইউএন হাউস ইন বাংলাদেশ’ উদ্বোধন করেন। সেখানে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের ৫০তম বার্ষিকীর আলোকচিত্র প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন। পরে তিনি বাংলাদেশস্থ জাতিসংঘ কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। জাতিসংঘ মহাসচিব দুপুরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে মিলিত হন। জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে শনিবার বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এছাড়া তিনি তরুণ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন। পরে জাতিসংঘ মহাসচিব পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন। রোববার সকাল ১০টায় জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ ত্যাগ করার কথা ।
জাতিসংঘ মহাসচিবের চারদিনব্যাপী বাংলাদেশ সফরের বিষয়টি বর্তমান ক্রান্তিকালে বাংলাদেশের জনগণের জন্য বেশ উৎসাহব্যাঞ্জক হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তাঁর লিখিত বক্তব্যে বাংলাদেশকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় সবচেয়ে বড় অবদানকারী দেশগুলোর মধ্যে একটি উল্লেখ করে বলেন; শান্তি, উন্নয়ন এবং মানবিক ত্রাণের প্রতি অঙ্গীকারের মাধ্যমে বাংলাদেশ এ মূল্যবোধের একটি জীবন্ত প্রতীক। তিনি আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নেতৃত্বে দেশ যখন একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন আমি বৃহত্তর গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য জনগণের আশাকে স্বীকৃতি জানাই। জাতীয় যাত্রার এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বাংলদেশে থাকতে পের আমি বিশেষভাবে আনন্দিত। বর্তমান সরকারকে আশ্বস্ত করে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, আপনারা জাতিসংঘকে অবিচল অংশীদার হিসেবে বিশ্বাস করতে পারেন, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে কাজ করে সবার জন্য একটি টেকসই এবং ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সহায়তা করবে জাতিসংঘ।
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং দেশের ‘প্রকৃত রূপান্তর’-এর জন্য সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রশংসা করেছেন। তিনি প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রতি জাতিসংঘের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং বলেছেন, তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য যা কিছু করতে পারেন তা করবেন এবং বাংলাদেশ ও এর জনগণের পাশে থাকবেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁর সফর ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তিকর প্রচারণা এবং বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াই করার চেয়েও বেশি কিছু করবে। তাঁর সমর্থনের আশ্বাস বাংলাদেশের জনগণের সাধারণ আকাক্সক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আমাদের সফল সংস্কার প্রক্রিয়া এবং গণতন্ত্রে উত্তরণে সহায়তা করবে। আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যের তাৎপর্য আমরা উপলব্ধি করতে পারি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ঘটিত অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে পতিত ফ্যাসিস্ট চক্রের নানা ষড়যন্ত্রের কথা আমরা জানি। বাংলাদেশ এবং এর জনগণের বিরুদ্ধে প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক মহল ও মিডিয়ার অপপ্রচার একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন বাস্তবতায় জাতিসংঘ মহাসচিব যেভাবে বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ালেন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগ ও গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করলেন, তা আমাদের জন্য খুবই আশাব্যঞ্জক। অন্তর্বর্তী সরকার এবং আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও সময়ের দাবি পূরণে সমর্থ হবে বলে আমরা আশা রাখি।