মুহাম্মদ আবুল হুসাইন

‘তুমি কি তাকে দেখনি, যে তার প্রবৃত্তিকে নিজের প্রভূ বানিয়ে নিয়েছে? তবুও কি তুমি তার যিম্মাদার হবে? তুমি কি মনে কর তাদের অধিকাংশই শুনতে পায় ও বুঝতে পারে? আসলে এরা তো জন্তু-জানোয়ারের মত, বরং তার চেয়েও অধিকতর পথভ্রষ্ট।’ -[আল-ফুরকান : ৪৩-৪৪]

“...যদি কেউ একজন মানুষকে হত্যা করে- যদি তা হত্যার দায়ে বা দেশে বিশৃঙ্খলা ছড়ানোর অপরাধে না হয় -তবে সে যেন সমগ্র মানুষকে হত্যা করলো; এবং যদি কেউ একটি জীবন বাঁচায়, তবে সে যেন সমগ্র মানব জাতির জীবন রক্ষা করলো।” (আল-মায়িদা, ৫:৩২)

আল্লাহ মানুষকে যে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন তা আর কোন সৃষ্টিকে দেননি। তিনি মানুষকে দিয়েছেন তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধির মর্যাদা। পৃথিবীর সব সৃষ্টিকে তিনি মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেছেন। তাঁর নির্দেশেই চাঁদ-সূর্য প্রতিদিন একটি সময়ে উদয় হয় ও অস্ত যায় এবং দিন ও রাতের আবর্তন হয়। ফলে আমরা কাজ করার জন্য পাই একটি সুন্দর আলোকিত দিন এবং বিশ্রামের জন্য পাই চমৎকার স্নিগ্ধ রাত। তিনি আমাদের দেহকাঠামো এমনভাবে বিন্যস্ত করেছেন যাতে আমরা সব সময় মাথা উঁচু করে চলাফেরা করতে পারি। তিনি আমাদেরকে এমন বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানার্জনের সক্ষমতা ও প্রজ্ঞা দিয়েছেন যে, আমরা অন্যান্য শক্তিমান প্রাণীকেও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারি এবং আল্লাহ’র সৃষ্টিকে ব্যবহার করে নিজেদের জীবনমানকে উন্নত করতে পারি। সৃষ্টিজগতের সকল প্রাণীকে আল্লাহ উলঙ্গ রেখেছেন কিন্তু মানুষকে পোশাক পরার আকল ও জ্ঞান দিয়েছেন। এ সবই মানুষের মর্যাদাকে সমুন্নত করার জন্য। আল্লাহ বলেন- “আমি আদাম সন্তানকে সম্মানিত করেছি, তাদের জন্য জলে স্থলে যানবাহনের ব্যবস্থা করেছি, তাদেরকে পবিত্র রিযক দিয়েছি আর আমি তাদেরকে আমার অধিকাংশ সৃষ্টির উপর মর্যাদায় শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” (আল-ইসরা’, ১৭:৭০)

আল্লাহ মানুষকে সর্বোৎকৃষ্ট রূপ-সৌন্দর্য, কথা বলার ক্ষমতা, উৎকৃষ্ট খাদ্য, পানীয়, বাহন ও বাসস্থান দিয়েছেন যা মানুষের বিশিষ্টতাকে নির্দেশ করে।

এসবই মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তার অফুরন্ত দয়ার কয়েকটি দৃশ্যমান নিদর্শন মাত্র। কিন্তু মানব প্রকৃতির মধ্যে আরও এমন কিছু রয়েছে, যা আরও বেশি গুরুত্ববহ ও মূল্যবান। তার মধ্যে একটি হল বিবেক বা ন্যায়-অন্যায় বোধ। এ বিবেক বা সুপ্রবৃত্তি মানুষের প্রকৃতিতে সহজাত। যেমন সূরা আশ্ শামস্-এ বলা হয়েছে : ‘কসম মানুষের নফসের (প্রবৃত্তির) এবং কসম সেই সত্তার যিনি তাকে সঠিকভাবে গঠন করেছেন, তারপর তার উপর পাপ ও নৈতিক বোধ ইলহাম করেছেন।’ [সূরা আশ শামস : ৭-৮]

বিবেক বা সুপ্রবৃত্তি সব সময়ই মানুষের সৎ বৃত্তির বিকাশ কামনা করে, মানুষকে সৎ পথে চালিত করে। মহানবী (সা.) বলেছেন- “যে কাজে তোমার মন স্থিতি লাভ করে এবং যে কাজে হৃদয় বা বিবেক স্বস্তি ও নিশ্চয়তা পায় তাই পুণ্য বা সুনীতি। পক্ষান্তরে যে কাজে তোমার মন স্থিরতা পায় না এবং বিবেক স্বস্তি পায় না তাই পাপ বা দুর্নীতি।”

আল কুরআনে মানুষের নফসের (প্রবৃত্তির) তিনটি রূপের কথা বলা হয়েছে। একটি নফস হল যা মানুষকে সব ধরনের অন্যায় ও দুষ্কৃতির কাজে উস্কানি দেয়। একে বলা হয় ‘নফসে আম্মারা’। দ্বিতীয় ধরনের নফস হল যা ভুল বা অন্যায় কাজ করলে, অন্যায় ও ভুল কথা চিন্তা করলে বা খারাপ নিয়ত বা মন-মানসিকতা পোষণ করলে মানুষকে লজ্জিত ও অনুতপ্ত করে, ভিতর থেকে মানুষকে তিরষ্কার করে। এর নাম হল ‘নফসে লাউয়ামা’। আমরা একে ‘বিবেক’ও বলতে পারি। তৃতীয় হল সে নফস, যা সত্য-সঠিক পথে চলা ও ভুল বা অন্যায় পথ পরিহার করার দরুন অন্তরে স্বস্তি ও নিশ্চিন্ততা অনুভব করে। এর নাম হলো ‘নফসে মুতমায়িন্না’।

মানুষের প্রবৃত্তিতে ‘নফসে লাউয়ামা’ও ‘নফসে মুতমায়িন্না’ মানুষের রূহ বা ক্বলব ও আধ্যাত্মিকবোধকে শক্তিশালী করে। অন্যদিকে ‘নফসে আম্মারা’ জৈববৃত্তি মানুষকে বস্তুজগতের প্রতি আকৃষ্ট করে। এ আকর্ষণ না থাকলে মানুষ জীবনবিমুখ বা বৈরাগ্যবাদের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে, যা আল্লাহ’র পছন্দ নয়। মানুষ যেহেতু পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি তাই তাকে জীবনবিমুখ হলে চলবে না, বরং পার্থিব জগতকে আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালনা করতে হবে। সুতরাং পার্থিব ও আধ্যাত্মিক উভয় দিকে ভারসাম্য রক্ষা করেই মানুষকে চলতে হবে। কারণ এখানেই মানুষের পরীক্ষা। এ পরীক্ষা থেকে কেউ মুক্ত নয়। পবিত্র কুরআনে হযরত ইউসুফ (আ.) দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। তাঁকেও এ কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাঁর বরাত দিয়ে কুরআন মজিদে বলা হয়েছে-’(ইউসুফ বলল) আমিও নফসের থেকে মুক্ত নই। নিশ্চই নফস মন্দ কাজের আদেশ দেয়। তবে আমার রব যার প্রতি অনুগ্রহ করেন তাকে ছাড়া।’ (সুরা ইউসুফ : ৫৩)।

মানুষ যখন ‘নফসে আম্মারা’ বা কুপ্রবৃত্তির দাস হয়ে পড়ে তখন তার বিবেক-বুদ্ধি লোপ পায়। তখন সে এমন সব জঘন্য কাজও করে ফেলে যা এমনকি ইতর প্রাণীরাও করে না। এ অবস্থারই ইঙ্গিত সূরা ফুরকানে করা হয়েছে যার উল্লেখ আমরা শুরুতেই করেছি। এ অবস্থায় সে চোখ থাকতেও অন্ধ ও কান থাকতেও বধিরের মত কাজ করে। এ ধরনের বিবেকহীন লোকদেরকে আল্লাহ হেদায়াত থেকে বঞ্চিত করেন। সূরা কাছাছে আল্লাহ বলেন- “তার চেয়ে বড় পথভ্রষ্ট আর কে আছে যে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত হেদায়াতের পরিবর্তে আপন প্রবৃত্তির অনুসরণ করলো।”- [আল-কাছাছ : ৫০]

তিরমিজি, সুনানে আহমদ ও ইবনে মাজায়ে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, ‘মুমিন গোনাহে লিপ্ত হলে তার কলবে একটি কালো দাগ পড়ে। তারপর যদি সে তওবা করে, পাপকাজ ছেড়ে দেয় এবং ক্ষমা চায়, তবে তার কলব পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। সে আবার গোনাহে জড়িত হলে কালো দাগ বেড়ে যায়। অবশেষে এই দাগ তার অন্তরকে পুরোপুরি ঢেকে দেয়।’

মানুষের নৈতিকতা, বিবেক বা চরিত্রেরই অপর নাম হল মনুষ্যত্ব। মনুষ্যত্ব বা বিবেকবোধের কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা বা আশরাফুল মাখলুকাত। মনুষ্যত্ব হারিয়ে গেলে মানুষ আর পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না বরং তার চেয়েও নীচে নেমে যায়।

প্রশ্ন হল- সৃষ্টির সেরা মানুষ কেন, কখন ও কীভাবে বিবেকহীন হয়? এ প্রশ্নের উত্তর স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন সূরা আত্ তীনে এভাবে দিয়েছেন :

“নিশ্চয়ই আমি মানুষকে উৎকৃষ্ট ছাঁচে সৃষ্টি করেছি। তারপর তাকে আবার ইতরের চেয়েও ইতর অবস্থানে ফিরিয়ে দেই। অবশ্য তাদেরকে না, যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে। তাদের জন্য আছে অফুরন্ত প্রতিদান।” (আট-তীন: ৪-৬)

সূরা আস শামসেও আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন সুস্পষ্ট হেদায়াত দিয়ে বলেছেন-

‘কসম মানুষের নাফ্সের আর তাঁর যিনি তা সামঞ্জস্যপূর্ণ করেছেন। অতঃপর তিনি তাকে অবহিত করেছেন তার পাপসমূহ ও তার তাকওয়া সম্পর্কে। নিঃসন্দেহে সে সফলকাম হয়েছে, যে তাকে পরিশুদ্ধ করেছে। এবং সে ব্যর্থ হয়েছে, যে তা (নাফস)-কে কলুষিত করেছে।’ আস শামস: (৭-৯)

বস্তুত, মানুষ যখন নিজেকে বল্গাহীন স্বাধীন মনে করে; যখন সে মহান সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক আল্লাহকে ভুলে যায়, তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞ হয় এবং আখেরাতে আল্লাহ’র কাছে জবাবদিহিতার বিষয়কে অবিশ্বাস করে, তখনই সেচ্ছাচার হয়ে পড়ে। আর এ স্বেচ্ছাচারি হতে গিয়ে সে মূলত কুপ্রবৃত্তির দাস হয়ে পড়ে। তখন তার কাছে ভোগবাদকে জীবনের সফলতার একমাত্র মানদণ্ড বলে মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত এ বস্তুবাদি বা ভোগবাদি ভুল জীবন দর্শন মানুষের সব সর্বনাশের মূল। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে এ ভুল বিশ্বাস বা ভুল মূল্যবোধই মানুষকে সীমাহীন লোভ, লালসা ও পাপাচারের দিকে ঠেলে দেয়। ফলে পৃথিবীতে বড় বড় জালিম স্বৈরাচার তৈরি হয় এবং মানুষ মানুষের দাসে পরিণত হয়।

সুতরাং, মানুষের জন্য আল্লাহ’র সবচেয়ে মূল্যবান দয়া হল ঈমান তথা জীবনের সফলতার প্রকৃত মূল্যবোধ, যা মানুষকে বিশেষভাবে জানানো হয়েছে নবী-রাসূলদের মাধ্যমে ‘ওহী’ বা ঐশী প্রত্যাদেশ প্রেরণ করে; যার উপর নির্ভর করে মানুষের মনুষ্যত্ব; যে মনুষ্যত্ব হারালে মানুষ আর মানুষ থাকে না, মানুষরূপী পশুতে পরিণত হয়।

বস্তুবাদী দর্শন মানুষকে শুধুমাত্র জৈববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির সমষ্টি মনে করলেও ইসলাম তা মনে করে না। শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তির কারণেই মানুষ ইতরতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। বরং বুদ্ধির জোরে মানুষ এমন উন্মত্ত ও পাশবিক আচরণও করতে পারে যা কোন ইতর প্রাণীর পক্ষেও সম্ভব হয় না।

ইসলাম মানুষের মনুষ্যত্ব বা বিবেকের পূর্ণ বিকাশ চায়। মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘নৈতিক চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্যই আমি আবির্ভূত হয়েছি।’

“হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, নিশ্চয়ই একজন মুমিন ব্যক্তি তার উত্তম চরিত্রগুণে সেসব আবেদ লোকের মর্যাদা লাভ করতে পারে, যারা সারা রাত নামাযে কাটায় আর সারা বছরই রোযা রাখে।” -[আবু দাউদ]

“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই সবচেয়ে উত্তম, যে চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম।” -[বুখারী, মুসলিম]