গাজায় দুর্ভিক্ষ ও অবরোধের নির্মম বাস্তবতা আজ বিশ্বকে ব্যথিত করছে। হাজারো প্রাণহানি, ধ্বংসস্তূপে পরিণত নগরী, ক্ষুধার্ত শিশু-এসব বন্ধ করতে সমাধানের পথ খোঁজা নিঃসন্দেহে সময়ের দাবি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে ২০ দফা পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দিয়েছেন, তা কি সত্যিই একটি ন্যায্য সমাধান, নাকি ফিলিস্তিনিদের জন্য নতুন এক দাসত্বের কাঠামো? পরিকল্পনার শুরুটা আকর্ষণীয় মনে হতে পারে- যুদ্ধবিরতি, জিম্মি বিনিময়, ত্রাণ প্রবেশাধিকার, হাসপাতাল ও অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ। এগুলো মানবিক দাবি এবং সেগুলো পূরণ অবশ্যই জরুরি। কিন্তু পরিকল্পনার গভীরে গেলে স্পষ্ট হয়, গাজার জনগণকে তাদের রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, একে এক প্রকার তত্ত্বাবধায়ক ভূখ-ে পরিণত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

প্রস্তাবনা অনুযায়ী “বোর্ড অব পিস” নামের নতুন আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করা হবে, যার নেতৃত্বে থাকবেন ট্রাম্প নিজেই, গাজার প্রশাসন, অর্থনীতি ও নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। এর সঙ্গে যুক্ত হবেন টনি ব্লেয়ারসহ আরও বিদেশি নেতারা। ফিলিস্তিনিদের জন্য যেখানে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলেছে, সেখানে এ ধরনের বিদেশি তত্ত্বাবধান আসলে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সরাসরি অস্বীকৃতি। আরও আশঙ্কাজনক হলো, পরিকল্পনায় হামাসসহ সব প্রতিরোধ আন্দোলনকে পুরোপুরি নিরস্ত্রীকরণ এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে নির্বাসনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছেÑঅস্ত্র জমা দিলে “সাধারণ ক্ষমা” মিলবে, আর যারা গাজা ছাড়তে চাইবে তাদের বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এর মানে হলো, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের শিকড় উপড়ে ফেলা এবং স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে চিরতরে গলা টিপে ধরা। স্বাধীনতার লড়াইকে ‘সন্ত্রাস’ আখ্যা দিয়ে চিরস্থায়ীভাবে খামচে ধরা কোনো সমাধান নয়; বরং সেটি আরেক ধরনের দাসত্ব চাপিয়ে দেওয়ার সমান। আরও উদ্বেগজনক অংশ হলোÑযে শর্তে হামাসকে নির্বাস্ত বা নিরস্ত্রীকরণ করে ‘সাধারণ ক্ষমা’ প্রস্তাব করা হয়েছে। ইতিহাস বলে যে রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে, তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক ভিত্তি উপড়ে ফেলে শান্তি স্থাপন করা যায় না।

অর্থনীতি ও উন্নয়নের নামে গড়ে তোলা হবে “বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল”, যা বহিরাগত বিনিয়োগকারীদের হাতে নিয়ন্ত্রিত থাকবে। ফিলিস্তিনিদের কাছে প্রতিশ্রুত হচ্ছে কর্মসংস্থান ও আধুনিক শহরের স্বপ্ন, কিন্তু বিনিময়ে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তাদের নিজস্ব সম্পদ, নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক অধিকার। এটি অনেকটা মরুভূমির তৃষ্ণার্ত মানুষকে পানি দেওয়ার নামে তার শ্বাসরোধ করার মতো। পরিকল্পনার আরেকটি বিপজ্জনক দিক হলো আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী (আইএসএফ) গঠনের প্রস্তাব। এর নেতৃত্ব বহিরাগত শক্তির হাতে থাকবে, স্থানীয় পুলিশ বাহিনী কেবল তাদের তত্ত্বাবধানে কাজ করবে। অর্থাৎ গাজার নিরাপত্তা থাকবে অন্যের হাতে, গাজাবাসীর হাতে নয়। এই ব্যবস্থা যদি স্থায়ী হয়, তাহলে গাজা কখনোই পূর্ণ স্বশাসন অর্জন করতে পারবে না।

সবচেয়ে বেদনাদায়ক হলো, অনেক আরব ও মুসলিম নেতৃত্ব এ পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। পাকিস্তান, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশও এতে জড়িয়ে পড়ছে। অথচ লাখো শহীদ তাদের প্রাণ দিয়েছেন এ ভূমিকে স্বাধীন করার জন্য, দখলদারের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য নয়। ফিলিস্তিনি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের ন্যায্য দাবি। গাজার পুনর্গঠন অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু তা হতে হবে ফিলিস্তিনি জনগণের অংশগ্রহণ, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে। অন্যথায় এ পরিকল্পনা ইতিহাসে শান্তি-চুক্তি হিসেবে নয়, বরং আত্মসমর্পণের দলিল হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ পর্যায়ে এসে আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো-শহীদদের রক্তকে অসম্মান না করে এমন একটি সমাধানের দাবি তোলা, যেখানে গাজার জনগণ নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই নির্ধারণ করবে, বাইরের কারো হাতে নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে নয়।