সবকিছুই তো চোখের সামনে হচ্ছে, সবার চোখের সামনে। চেয়ে চেয়ে দেখছে জাতিসংঘ, সভ্যতার শাসকবর্গও। তবে জাতিসংঘ মাঝে মাঝে কিছু কথা বলে এবং ঘোষণা দেয়। বিষয়টা অনেকটা কাগুজে ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এজন্য দায়ী সভ্যতার শাসকবর্গও। গত শুক্রবার জাতিসংঘ অবরুদ্ধ ও যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। জাতিসংঘের অধীন দুর্ভিক্ষ তদারককারী সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি)-এ ঘোষণা দেয়। আইপিসির প্রতিবেদনে বলা হয় গাজা শহর ও এর চারপাশের অঞ্চলে ইতিমধ্যে পঞ্চম পর্যায়ের বিপর্যয়কর মাত্রার দুর্ভিক্ষ চলছে। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে একই ধরনের অবস্থা মধ্য গাজার দাইর আল-বালাহ ও দক্ষিণ খান ইউনুসে সম্প্রসারিত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয় বর্তমানে গাজার পাঁচ লাখের বেশি বাসিন্দা অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ পঞ্চম পর্যায়ের বিপর্যয়কর মাত্রায় দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া ১০ লাখ ৭০ হাজার বাসিন্দা অর্থাৎ জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ চতুর্থ পর্যায়ের জরুরি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আরো তিন লাখ ৯৬ হাজার বাসিন্দা, অর্থাৎ ২০ শতাংশ তৃতীয় পর্যায়ের সংকটপূর্ণ মাত্রার দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া উত্তর গাজায় দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি গাজা শহরের মতোই বা তার চেয়ে ভয়াবহ হতে পারে বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়। আইসিপির প্রতিবেদনে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়, আগাামী জুনের আগে গাজায় পাঁচ থেকে ছয় বছর বয়সী এক লাখ ৩২ হাজার শিশু চরম অপুষ্টিতে আক্রান্ত হতে পারে।

জাতিসংঘ তো অবরুদ্ধ ও যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা করলো। এতে কি পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটবে? দুর্ভিক্ষ নিয়েও গবেষণা হলো, বিশ্লেষণ হলো এবং দুর্ভিক্ষের মাত্রা নিয়েও কথা বলা হলো। পঞ্চম পর্যায়ের, চতুর্থ পর্যায়েল এবং তৃতীয় পর্যায়ের বিপর্যয়কর দুর্ভিক্ষের এই যে মাত্রা নির্ধারণ করা হলো, তাতে সভ্যতার কী আসে যায়? এসব কর্মকাণ্ডে মনে হতে পারে গাজায় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ খুব সিরিয়াস। কিন্তু সভ্যতার শাসকদের আচরণ কেমন? সভ্যতার শাসকদের তো মোটেও সভ্য মনে হচ্ছে না। বরং তাদের অসভ্য ও বর্বর বললেও কম বলা হবে। আসলে ওদের চিহ্নিত করার মত উপযুক্ত শব্দ এখনো অভিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তাই সহজ ভাষায় আমরা বলতে পারি সভ্যতার রঙ্গমঞ্চে ওরা আসলে খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে যাচ্ছে। আর আমরা বসবাস করছি প্রহসনের এক সভ্যতায়।

সভ্যতার এ বেলায় জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘গাজায় জীবন্ত নরকের বর্ণনার জন্য আরো কোনো শব্দ বাকি ছিল না। এর সঙ্গে নতুন এক শব্দ যুক্ত হয়েছে ‘দুর্ভিক্ষ’। কোনো রহস্য নেই যে, এটি মানবসৃষ্ট বিপর্যয়, একটি নৈতিক অিভিযোগ ও মানবতার ব্যর্থতা।’ তিনি আরো বলেন, দখলদার শক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনের অধীন ইসরাইলের এ জনপদে খাবার ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের দায়বদ্ধতা রয়েছে। কোনো দায়মুক্তি ছাড়া আমরা, এ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে দিতে পারি না।’ জাতিসংঘের মত প্রতিষ্ঠানের মহাসচিব তো গাজা পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন। কিন্তু এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলো কি মহাসচিবের বক্তব্যের প্রতি সঙ্গত সম্মান প্রদর্শনে সক্ষম হবেন? অতীতে তারা অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। এখনো যদি তারা কর্তব্য পালনের অক্ষম হন, তাহলে তো তাদের নৈতিক মান, মানবিক উপলব্ধি নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দেবে। এমন প্রশ্নের সুরাহা না হলে এ সভ্যতা ও সভ্যতার শাসকদের কোনো প্রায়াজন আছে কি মানবজাতির?