গত ২০ নভেম্বর রাজধানীতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিসদের এক বৈঠকে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ-২০২৫ খসড়া অনুমোদিত হয়েছে। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এবং স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার মাইলফলক। এর মাধ্যমে বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দীর্ঘ দিনের একটি প্রত্যাশা পূরণ হতে যাচ্ছে। এখন সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কাজ শেষ হলে বিচার কাজে যুক্ত অধ:স্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে থাকবে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টে আর্থিক ক্ষমতাও নিশ্চিত হবে। তবে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনকারী বিচারকের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা আগের মতোই আইন মন্ত্রণালয়ের হাতেই থাকবে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হবে।

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা বিশেষ করে নিম্ন আদালতের বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে অনেক দিন ধরেই নানা অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল। এবার সে অভিযোগ কিছুটা হলেও সুরাহা করার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। বিগত সরকার আমলে ব্যাপক দলীয়করণের মাধ্যমে বিচার বিভাগকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কোন কোন বিচারক রাজনৈতিক নেতাদের মতো কথা বলতেন। একজন বিচারপতি সরকার দলীয় সংগঠনের সভায় গিয়ে বলেছিলেন, এদেশে স্বাধীনতা বিরোধিদের কোন স্থান নেই। আর একজন বিচারক বলেছিলেন, আমরা (বিচারকগণ) হচ্ছি শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ। এধরনের বিচারকগণ দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারকার্য সম্পন্ন করবেন এটাই স্বাভাবিক। গত বছর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্রদের প্রতিবাদের মুখে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ অন্তত ৬জন বিচারপতি পদত্যাগ করেন। পৃথিবীর ইতহাসে এ ধরনের ঘটনা বিরল। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বিগত সরকারকে তুষ্ট করার মানসে এক অনাকাক্সিক্ষত রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধান থেকে বাদ দেন। তার সে রায় দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল।

আদালতের এ রায়ের উপর ভিত্তি করে নির্বাচনের নামে প্রহসন করে বিগত সরকার একটানা সাড়ে ১৫ বছর দেশে স্বৈরশাসন চালিয়েছিল। আগামীতে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর আলোকে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হলে অধ:স্তন আদালতের বিচারক নিয়োগ, বদলি এবং অন্যান্য বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। অধ:স্তন আদালতের বিচারকদের আর সরকারের আইন মন্ত্রণালয়ের মুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে হবে না। বিদ্যমান অবস্থায় অধ:স্তন আদালতের বিচারকদের যে কোন সিদ্ধান্তের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের মুখোমুখি হয়ে থাকতে হচ্ছে। সে অবস্থার অবসান হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, শুধু আইনি অধিকার দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না।

আইন বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সিনিয়রিটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কোন ব্যক্তির পেশাগত জীবনে যদি কোন দুর্নীতি বা অদক্ষতার অভিযোগ না থাকে তাহলে তাকে সিনিয়রিটির ভিত্তিতে বিচারক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। কারণ সিনিয়রিটি লঙ্ঘন করা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মনে হতাশা নেমে আসতে পারে। বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার উপর নির্ভর করে একটি দেশের শাসন ব্যবস্থা কেমন চলবে। বিচারহীনতা কখনোই একটি দেশকে কাঙ্খিত মাত্রায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে পারে না। বিচারক হচ্ছেন জমিনে সরাসরি আল্লাহ্র প্রতিনিধি। তাই তাদের সকল প্রকার ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যেতে হবে।