দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট কমানোর দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, এ মুহূর্তে পলিসি রেট কমানোর কোন পরিকল্পনা নেই। তার অর্থ হচ্ছে, আপাতত বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট ১০ শতাংশ অপরিবর্তিতই থাকছে। উল্লেখ্য, দীর্ঘ দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট ছিল ৫ শতাংশ। করোনা উত্তর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির হার বিগত ৪০ বছরের রেকর্ড অতিক্রম করে ৯ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফেড) ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ স্থবিরতার ঝুঁকি নিয়ে হলেও পলিসি রেট (সিডিউল ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্বল্পকালীনের জন্য যে ঋণ বা ধার গ্রহণ করে তাকে পলিসি রেট বা রেপো রেট বলা হয়) বারবার বৃদ্ধি করে। পলিসি রেট বৃদ্ধি করার ফলে ব্যাংক ঋণের সুদের হার (সিডিউল ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের ঋণদানকালে যে সুদ আদায় করে সেটাই ব্যাংক ঋণের সুদের হার) ব্যাংক স্বাভাবিকভাবেই আনুপাতিকভাবে বৃদ্ধি পায়।
পলিসি রেট বৃদ্ধি করা হলে উদ্যোক্তা এবং সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ আগের তুলনায় ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ব্যক্তিখাতে ব্যাংক ঋণের প্রবাহ কমে যায়। বাজারে অর্থের যোগান কমে যায়। এ ব্যবস্থা উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে সহায়তা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফেড) দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্তত ৭৭টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের পলিসি রেট বাড়িয়ে দেয়। অধিকাংশ দেশই এ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সমর্থ হয়। এমনকি সমস্যা সঙ্কুল দ্বীপ দেশ শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে এক পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। সম্প্রতি প্রাপ্ত সংবাদ মোতাবেক দেশটি তাদের মূল্যস্ফীতির হার ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। বিগত সরকার আমলে বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার পলিসি রেট বাড়ালেও ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ ফিক্সড করে রেখেছিল। সরকার সমর্থক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী নানা কৌশলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা উদ্দীষ্ট কাজে ব্যবহার না করে ভিন্ন খাতে ব্যবহার করে।
ফলে মূল্যস্ফীতি না কমে বরং আরো বেড়েছে। গত বছর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের ম্যানেজমেন্টে পরিবর্তন আনা হয়। নতুন ম্যানেজমেন্ট ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫/১৬ শতাংশ। উচ্চ সুদে উদ্যোক্তাগণ ব্যাংক ঋণ নিতে পারছে না। ফলে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ২৯ শতাংশে নেমে এসেছে, যা বিগত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ অবস্থায় ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্থবিরতা বিরাজ করছে। উদ্যোক্তাগণ নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এ অবস্থায় দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট কমানোর জন্য দাবি জানিয়েছেন।
ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ হারের কারণে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ প্রবাহ বিগত ১৫/১৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মারাত্মক বন্ধ্যাত্ব নেমে আসবে। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ মন্থর হয়ে পড়বে, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘ দিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করার পেছনে অন্য কারণ নিহিত রয়েছে। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট বাড়িয়ে কমিয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। পরিবহন সেক্টরে ব্যাপক চাঁদাবাজিবন্ধকরণ এবং বাজারে তৎপর রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দমন করা না গেলে অভ্যন্তরীণ বাজারে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। তাই এ ব্যাপারে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে।