মানবসমাজে পুরস্কারের রেওয়াজ বেশ প্রাচীন। ভালো কাজের জন্য, প্রতিযোগিতায় সাফল্যের জন্য মানুষ পুরস্কৃত হয়ে থাকে। এর বিপরীতে অন্য শব্দ আছে বাংলা ভাষায়, সেটি হলো ‘তিরস্কার’। মন্দ কাজের জন্য, প্রতিযোগিতায় ব্যর্থতার জন্য মানুষ তিরস্কৃত হয়। সব ভাষাতেই এ রকম শব্দ আছে এবং সব সমাজেই পুরস্কার ও তিরস্কারের বিষয় আছে। পুরস্কার হলো সম্মানের বিষয়, আর তিরস্কার হলো অসম্মান ও নিন্দার বিষয়। পুরস্কারই সব মানুষের কাম্য, কিন্তু চাইলেই কি তা পাওয়া যায়? পুরস্কারের জন্য প্রয়োজন হয় সঙ্গত কর্ম ও যোগ্যতা। মহৎ ও কাক্সিক্ষত কর্মের জন্য পৃথিবীতে বড় বড় বহু পুরস্কারের প্রচলন হয়েছে। এরমধ্যে শীর্ষে রয়েছে ‘নোবেল পুরস্কার’। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নোবেল নিয়ে শুধু আলোচনা নয়, সমালোচনাও হচ্ছে। অনুপযুক্ত, এমনকি তিরস্কৃত হওয়ার মত ব্যক্তিরাও নাকি আজকাল নোবেল পেয়ে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে এবার উঠে এসেছে শান্তিতে নোবেল জয়ী মারিয়া কোরিনা মাচাদো-এর নাম। ভদ্র মহিলা ভেনেজুয়েলার নাগরিক।

শান্তিতে নোবেল নিয়ে এবার বেশ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। আলোচনায় জড়িয়ে গেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, শুক্রবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের কাছে নোবেল পুরস্কার নিয়ে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, যিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন, তিনি আজ আমাকে ফোন করে বলেছেন-‘আমি এ পুরস্কার আপনার সম্মানে গ্রহণ করেছি। কারণ, প্রকৃতপক্ষে এটি আপনারই প্রাপ্য।’ ট্রাম্প আরো বলেন, এটি আসলেই ভদ্রতা ও সৌজন্যের পরিচয়। আমি অবশ্য তখন তাকে বলিনি-‘তাহলে পুরস্কারটা আমাকে দিয়ে দিন।’ নোবেল কমিটির সিদ্ধান্তকে সরাসরি সমালোচনা না করলেও নিজেকে অসংখ্য যুদ্ধ সমাধানের কৃতিত্ব দিয়ে ট্রাম্প দাবি করেন-শান্তির জন্য তার অবদান এত বেশি যে, পুরস্কারটি তাকে দেওয়া উচিত ছিল।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে এক পোস্টে মারিয়া কোরিনা লেখেন, আমি এ পুরস্কার ভেনেজুয়েলার কষ্টভোগী জনগণ ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে উৎসর্গ করছি, যিনি আমাদের আন্দোলনে দৃঢ় সহায়তা করেছেন। এর আগে শুক্রবার নোবেল কমিটি শান্তিতে নোবেল জয়ী হিসেবে ভেনেজুয়েরার বিরোধী নেতা মারিয়ার নাম ঘোষণা করে। কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়, গণতন্ত্র ও মানবাদিকারের জন্য দীর্ঘদিনের সংগ্রামের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে এ পুরস্কার দেওয়া হলো। এ ঘোষণার পর নোবেল কমিটির সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে হোয়াইট হাউস বলেছিল, ‘পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে নোবেল কমিটি শান্তির চেয়ে রাজনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। আলোচনা-সমালোচনা এখানেই থেমে থাকেনি। নানাভাবে তীর্যক সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছেন মারিয়া, ট্রাম্প এবং নোবেল কমিটি। নোবেল কমিটির বিবেচনাবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, প্রশ্ন উঠেছে মারিয়ার পুরস্কার প্রাপ্তির যোগ্যতা নিয়েও। এমন প্রশ্নও উঠেছে, গাজা ধ্বংসের কারিগর ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরস্কারের সাথে প্রাসঙ্গিক হন কেমন করে? হোয়াইট হাউস তো বলেছে, পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে নোবেল কমিটি শান্তির চেয়ে রাজনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এমন মন্তব্যের পর বিষয়টির ব্যাপক বিশ্লেষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। সে বিশ্লেষণে যুক্ত হয়েছেন অনেকেই। প্রসঙ্গত এখানে মিশেল এলনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি নারী আন্দোলনমূলক একটি শান্তি ও সামাজিক সংগঠনের সমন্বয়ক। সংগঠনটির নাম কোডপিংক। মিশেল এলনার বলেছেন, মারিয়ার নোবেল বিজয়ে খুশি হতে পারি নি; কারণ এতে খুশির কিছু নেই। যার রাজনীতি অগণিত মানুষের জীবনে অনন্ত দুর্ভোগ এনেছে, সে ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করা নিছক ‘ভণ্ডামি’ ছাড়া আর কিছু নয়। মারিয়া আসলে কিসের প্রতীক? তার রাজনীতির সাথে ‘শান্তি’ শব্দটির কোনো সম্পর্ক নেই। ২০২৫ সালের ‘শান্তি বলতে যদি এটাই বোঝানো হয়, তাহলে বলা যেতে পারেÑ নোবেল পুরস্কার তার সব বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। মিশেল এলনার বলেন, আমি ভেনেজুয়েলায় জন্মগ্রহণকারী একজন আমেরিকান। আমি খুব ভালো করে জানি, মারিয়া কিসের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি হলেন ওয়াশিংটনের রেজিম চেঞ্জ যন্ত্রের হাস্যোজ্জ্বল মুখ। কোনো দেশের এক সরকারকে ফেলে দিয়ে অন্য সরকারকে বসানোর কারিগর তিনি। মারিয়া হলেন নিষেধাজ্ঞা, বেসরকারীকরণ ও বিদেশি হস্তক্ষেপকে ‘গণতন্ত্র’ নামে সাজিয়ে তোলার এক সুশীল কণ্ঠস্বর। অথচ মারিয়ার রাজনীতি সহিংসতায় ভরপুর। তিনি প্রকাশ্যে বিদেশী হস্তক্ষেপকে আহ্বান জানিয়েছেন। এমনকি গাজা ধ্বংসের খলনায়ক ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে তিনি বলেছেনÑ যেন বোমা মেরে ভেনেজুয়েলাকে ‘মুক্ত’ করেন। তিনি নিজের দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়েছেন, অথচ তিনি জানেনÑ অবরোধ বা নিষেদাজ্ঞা নীরব যুদ্ধেরও একটি রূপ। মিশেল এলনার বলেন, মারিয়া কোরিনার জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বিভাজন সৃষ্টি করে, ভেনেজুয়েলার সার্বভৌমত্ব ক্ষয় করে এবং জনগণের মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকার কেড়ে নিয়ে তিনি তার পুরো রাজনৈতিক জীবন কাটিয়েছেন। এমন বিশ্লেষণ থেকে উপলব্ধি করা যায়, কেন মিশেল এলনার নোবেল শান্তি পুরস্কারের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

এলনার ট্রাম্প ও মারিয়ার কিছু কার্যক্রম নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ট্রাম্প যে পদক্ষেপের মাধ্যমে অভিবাসী শিশুদের খাঁচায় আটকে রেখেছিলেন, অনেক পরিবারকে আলাদা করে দিয়েছিলেন এবং ট্রাম্পের যে নীতির কারণে আজ হাজারো ভেনেজুয়েলান মা তাদের হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের খুঁজে ফিরছেন, সে কুৎসিত উদ্যোগ ও নীতিকে মারিয়া ‘দৃঢ় পদক্ষেপ’ বলে প্রশংসা করেছেন। এই যদি হয় শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের যোগ্যতা, তবে ‘শান্তি’ শব্দটা অপমানিত হবে। আসলে মারিয়া শান্তির প্রতীক নন। তিনি বৈশ্বিক এক জোটের অংশ- যেখানে ফ্যাসিবাদ, জায়নবাদ ও নিউলিবারালিজম (নব্য উদারনীতি) জড়িত। এ জোট মুখে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘শান্তির’ কথা বলে, কিন্তু তাদের আসল লক্ষ্য হলো দমন ও আধিপত্য।

বর্তমান সভ্যতায় বিশ্বব্যবস্থায় মারিয়া কোরিনা মাচাদোর মতো মানুষ নোবেল শান্তি পুরস্কার পান; অথচ তিনি ট্রাম্পের আজ্ঞাবহ এবং ফ্যাসিবাদ ও জায়নবাদের সমর্থক। অশান্তির পতাকাবাহী নোবেল পেলে তো, এ পুরস্কার নিয়ে কথা উঠবেই। ফলে প্রশ্ন জেগেছে, নোবেল পাওয়ার মতো প্রকৃত মানুষ কি ধরনীতে নেই? থাকলে মারিয়ারা কেন নোবেল পান, আর ট্রাম্পরা কী করে নোবেলের আশায় প্রহর গোনেন? প্রশ্ন জাগেÑ এ কোন সভ্যতায়, এ কেমন বিশ্বব্যবস্থায় আমাদের বসবাস? প্রকৃত শান্তিকামীরা তো এখন গাজার ধ্বংসস্তূপের চারপাশে বিচরণ করছেন। তাদের কেউ চিকিৎসক, কেউ ত্রাণকর্মী, কেউবা সাংবাদিক। জীবনবাজি রেখে তারা গাজার মজলুম মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ফ্লোটিলার বীর যোদ্ধারা ইসরাইলের অবরোধ ভাঙ্গার চেষ্টা করেছেন। নোবেল প্রাইজ প্রদানের শ্রেষ্ঠ ভূমি তো এখন গাজা। এখান থেকেই তো বেছে নিতে হবে শান্তির সোনালি মানুষদের। এদিকে দৃষ্টি নেই কেন নোবেল কমিটির। বর্ণবাদের কোনো সমস্যা নেই তো?