রাজধানী ঢাকায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের হঠাৎ জমায়েত হয়ে ঝটিকা মিছিল করার প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এ হনন, ধরনের মিছিল কখনো ভোরে, কখনো দিনের বেলা রাস্তাঘাট ব্যস্ত সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, তাদের এসব অপতৎপরতা তত বাড়ছে। উদ্দেশ্য স্পষ্ট- রাজধানীতে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেওয়া এবং অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা। এ বিষয়ে দৈনিক সংগ্রাম সম্প্রতি একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয় যে, গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট বলছে, ঝটিকা মিছিল কেবলমাত্র রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের জন্য নয়; এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ককটেল বিস্ফোরণ, দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা, এমনকি অপরাধমূলক কর্মকা-ও। শুধু দেশীয় নেতারাই নয়, বিদেশে পালিয়ে থাকা শীর্ষ নেতারাও এসব কর্মসূচির নির্দেশনা দিচ্ছেন এবং অর্থায়ন করছেন। আশঙ্কাজনক বিষয় হলো, গ্রেফতার হওয়া বহু ব্যক্তি স্বীকার করেছেÑটাকার বিনিময়ে তারা এসব মিছিলে অংশগ্রহণ করছে। এতে বোঝা যায়, রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, বরং টাকার বিনিময়ে ভাড়া করা ভিড় তৈরি করে রাজধানীকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে। এভাবে রাজনীতিকে অপরাধমূলক কর্মকা-ের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের জন্য গুরুতর হুমকি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নিষ্ক্রিয় নয়। গত কয়েক দিনে একাধিক অভিযান চালিয়ে দু’শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। উদ্ধার করা হয়েছে ব্যানার ও ককটেল। কিন্তু প্রশ্ন হলো-এত নজরদারি, গোয়েন্দা তথ্য ও টহল সত্ত্বেও কীভাবে নিষিদ্ধ একটি দল ধারাবাহিকভাবে রাজধানীতে ঝটিকা মিছিল করতে পারছে? এটি নিঃসন্দেহে পুলিশের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে ঢাকা একটি জনবহুল, জটিল শহর। এখানে শতভাগ প্রতিরোধ করা সবসময় সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও পুলিশের ব্যর্থতা ধরা পড়ে যখন দেখা যায়, সিনিয়র অফিসারের নির্দেশনা অমান্য করে কেউ মাঠে উপস্থিত থাকে না এবং মিছিল ঠেকাতে ব্যর্থ হয়। এজন্যই সম্প্রতি কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে আরেকটি বড় সমস্যা হলো আইনি প্রক্রিয়ায় শিথিলতা। আটক হওয়া অনেক নেতাকর্মী দ্রুত জামিনে বের হয়ে আবারও একই কর্মকা-ে জড়াচ্ছে। আদালতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা সক্রিয়ভাবে কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে একদিকে পুলিশের পরিশ্রম ভেস্তে যাচ্ছে, অন্যদিকে অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এড়িয়ে গিয়ে আরও সাহস পাচ্ছে। এ চক্র ভাঙতে হলে আইনি প্রক্রিয়ায় সংস্কার আনতে হবে এবং জামিনের অপব্যবহার রোধ করতে হবে।
ঢাকায় অচেনা লোকজনের হঠাৎ ভিড়, হোটেল, ফাঁকা ফ্ল্যাট বা ছাত্রাবাসে আত্মগোপনÑসবকিছুই সাধারণ মানুষের নজরে আসছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বারবার বলছে, সন্দেহজনক তৎপরতা বা অপরিচিত লোকজনের তথ্য দিলে শতভাগ তথ্যদাতার পরিচয় গোপন রাখা হবে। তাই নাগরিক সমাজকেও দায়িত্ব নিতে হবে। রাজধানীকে নিরাপদ রাখতে শুধু পুলিশ নয়, সাধারণ মানুষকেও সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া মনে রাখতে হবে, নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ এক সময় দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। তাদের একটি বড় সামাজিক ভিত্তি ও সমর্থকগোষ্ঠী এখনো দেশে-বিদেশে আছে। তারা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেও একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়নি। এ অবস্থায় তাদের ছদ্মবেশী কার্যক্রম, অর্থনৈতিক শক্তি এবং বিদেশি মদদ মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এসব তৎপরতা বাড়তে পারে। তাই এখনই প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ।
প্রথমত, গোয়েন্দা তৎপরতা আরও জোরদার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শুধু গ্রেফতার নয়, গোড়া থেকে এ ধরনের কর্মসূচি ঠেকাতে হবে। তৃতীয়ত, আইনি প্রক্রিয়ার দুর্বলতা কাটিয়ে জামিনের অপব্যবহার রোধ করা দরকার। চতুর্থত, নাগরিক সমাজের সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো-রাজনীতিকে অর্থ ও সহিংসতার বাইরে নিয়ে আসতে হবে।
ঝটিকা মিছিল সাময়িক আতঙ্ক তৈরি করতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র যদি দৃঢ় অবস্থানে থাকে, তবে তা কখনো জনআকাক্সক্ষার জায়গা দখল করতে পারবে না। রাজধানীর শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা এখন শুধু পুলিশের নয়, সরকারের সামগ্রিক নীতিনির্ধারণী দক্ষতারও পরীক্ষা। তাই অস্থিতিশীলতার যে কোনো অপচেষ্টা রুখে দিতে রাষ্ট্র ও সমাজকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে।