গত বছরের ৫ আগস্ট দেশের রাজপথে ছাত্র-জনতার অসাধারণ গণজাগরণ এবং গণঅভ্যুত্থানের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। সে থেকে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে এবং সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী তিনি বর্তমানে ভারতের মাটিতে অবস্থান করছেন। সরকার ইতোমধ্যে ভারত সরকারকে কূটনৈতিক বার্তা (নোট ভারবালে) পাঠিয়ে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়েছে। কিন্তু গত ৪ আগস্ট পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের বক্তব্যে স্পষ্ট, ভারত এখনো কোনো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
এমন প্রেক্ষাপটে জাতির সামনে একটি বড় প্রশ্ন: শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন কবে? আদৌ তিনি ফিরবেন কি না? কিংবা ফেরানো সম্ভব হবে কি না? এসব প্রশ্ন শুধু একজন রাজনৈতিক ব্যক্তির ভবিষ্যৎ নয়Ñএর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের বিচারপ্রক্রিয়ার নির্ভরযোগ্যতা, আন্তর্জাতিক কূটনীতির ভারসাম্য এবং গণতন্ত্রের নৈতিক ভিত্তি। তৌহিদ হোসেন স্পষ্ট করে দিয়েছেন, “শেখ হাসিনার বিচার শুরু হয়ে গেছে। কেউ আসুক বা না আসুক, বিচার চলবে।” এটি একদিকে যেমন সরকারের আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ, তেমনি এ কথার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে যে সরকার কোনো আন্তর্জাতিক বাধা বা রাজনৈতিক চাপকে পরোয়া না করে বিচার চালিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রশ্ন হচ্ছে, শেখ হাসিনাকে অনুপস্থিত রেখে কতটুকু কার্যকরভাবে এ বিচারপ্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে?
আন্তর্জাতিক অপরাধ বা রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রশ্নে যেকোনো প্রত্যর্পণের বিষয়টি জটিল এবং দীর্ঘসূত্রতা সাপেক্ষ। অনেক সময় আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার চুক্তি, এমনকি রাজনৈতিক বিবেচনাও এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। ভারত সরকার এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না দিলেও ধরে নেয়া যায়, বিষয়টি তাদের কূটনৈতিক বিবেচনায় রয়েছে। তবে এ দেরি জনমনে নানা প্রশ্ন ও সন্দেহের জন্ম দিচ্ছে। কী কারণে ভারত সাড়া দিচ্ছে না, সেটি স্পষ্ট না হওয়ায় জনগণের আস্থার জায়গায় ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে। তবে বিষয়টি এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের আরেকটি বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক সহায়তা চাইবার দরকার এখনই দেখা যাচ্ছে না। তবে ভবিষ্যতে সরকার চাইলে নিতে পারে।” এ কথাটি ইঙ্গিত দিচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার হয়তো দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার পথেই অগ্রসর হতে চাইছে। তবে আন্তর্জাতিক আদালত, ইন্টারপোল বা জাতিসংঘের বিভিন্ন মেকানিজম ব্যবহার করেও অপরাধীদের প্রত্যর্পণ ঘটানো সম্ভব, যদি সরকার দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত থাকে।
শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ এবং বিচার এ মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নৈতিক প্রেক্ষাপটে এক সংবেদনশীল ইস্যু। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, যিনি দীর্ঘকাল ধরে দেশের রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি এবং গণবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ উঠলে সেটি কোনো সাধারণ বিষয় নয়। তার অনুপস্থিতিতে বিচার চললেও, আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে তা যথাযথ গ্রহণযোগ্যতা পাবে কি না, সেটিও একটি বিবেচনার বিষয়। এ মুহূর্তে সবচেয়ে প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য ও স্বচ্ছতা। সরকারকে অবশ্যই বিস্তারিতভাবে জানাতে হবেÑকী ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে প্রত্যর্পণ চাওয়া হয়েছে, ভারত কী বলেছে বা বলেনি, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কী কী পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ এড়াতে সরকারের উচিত, বিচারপ্রক্রিয়াকে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা, পেশাদারিত্ব ও মানবাধিকারের মানদণ্ডে পরিচালিত করা।
জাতি জানতে চায়, শেখ হাসিনার বিচার কী সত্যিই শেষ পর্যন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে, নাকি এটি আইনি ও কূটনৈতিক জটিলতার আবর্তে ধীর গতিতে হারিয়ে যাবে। জনগণের সে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে কূটনৈতিক সাহসিকতা, আইনি দক্ষতা এবং রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার মাধ্যমে। শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন কবে হবেÑএ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর এখনো অনিশ্চিত। তবে এ অনিশ্চয়তার মধ্যেও সরকারের দৃঢ়তা এবং জনগণের প্রত্যাশা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ইঙ্গিত করছে: ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা এ রাষ্ট্রের নৈতিক পুনর্গঠন। এ পথ সহজ নয়, কিন্তু সময় এসেছেÑআত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সে পথে অগ্রসর হওয়ার।