এবারের ঈদে ও পহেলা বৈশাখের আয়োজন চলাকালে সাধারণ মানুষ বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলেন। তারা বারবার বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশংসা করছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস আরো অন্তত ৫ বছর দেশ পরিচালনায় থাকুন, এমনটাও দাবি করেছিলেন। সাধারণ মানুষের ঐ স্বস্তি ও উচ্ছ্বাসের একটি বড়ো কারণ ছিল, অনেক বছর পর তারা তুলনামূলক স্বস্তিতে ও নির্বিঘ্নে একটি রোজার মাস অতিবাহিত করতে পেরেছিলেন। আর রোজার মাস ভালো যাওয়ার মূল কারণ ছিল, এবারের রোজায় নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিশেষ করে রোজার মাসে যে খাদ্যদ্রব্যগুলোর প্রয়োজন বেশি অনুভূত হয় সেগুলোর দাম মানুষের হাতের নাগালেই ছিল।
তখন থেকেই সাধারণ মানুষের এমনও দাবি ছিল যাতে রোজার মাসের মতোই অন্য মাসগুলোতেও বাজার মনিটরিং অব্যাহত রাখা হয় এবং জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য সরকারের তরফ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু জনগণের সে প্রত্যাশা সর্বাগ্রে পূরণ হবে কিনা- তা নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। মনে রাখতে হবে যে, রোজার মাসেও সবজিসহ রোজার উপকরণের দাম অনেকটা কমলেও আমিষের বাজারে অর্থাৎ মাছ, গোশত বা ডিমের বাজারে খুব বেশি স্বস্তি মানুষ পায়নি। ইফতার বাজারগুলোর ওপরও সরকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। জিনিসপত্রের দাম কম থাকার কারণে ইফতারের বাজারে যে স্বস্তিদায়ক প্রভাব পড়ার কথা ছিল, তাও কিন্তু দৃশ্যমান হয়নি।
আর রোজা ও ঈদের লম্বা ছুটি পার হওয়ার পরপরই সরকারের তরফ থেকে দুটো সিদ্ধান্ত আসায় জনমনে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। একটি হলো সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধি আর অন্যটি হলো নতুন শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য গ্যাসের দাম বৃদ্ধি। নতুন শিল্পে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধির ফলে শিল্পে প্রতি ইউনিট গ্যাসের মূল্য এখন ৩০ টাকার পরিবর্তে ৪০ টাকা পরিশোধ করতে হবে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত নতুন শিল্প উদ্যোক্তাদের আশাহত করেছে। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পরে দেশের অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দেশের শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যেও আশার সঞ্চার হয়েছে। বিগত সরকারের শাসনামলে শিল্পবান্ধব পরিবেশ না থাকায় নতুন শিল্প গড়ে ওঠেনি। ফলে, এখন এসে অনেকেই নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। অতিসম্প্রতি সরকার সফলভাবে একটি বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন যেখানে বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশের বিনিয়োগকারীরা সমবেত হয়েছিলেন এবং সরকার এ আয়োজনে অভূতপূর্ব সাড়াও পেয়েছিলেন। অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারীও বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন আর সরকারও নানাভাবে তাদেরকে আশ্বস্ত করেছিলেন। এমতাবস্থায় নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অর্থনীতির অঙ্গনের সার্বিক উচ্ছ্বাসকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
অপরদিকে সয়াবিন তেলের দাম লিটার প্রতি ১৪ টাকা বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের ফলে দরিদ্র জনগণের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। সয়াবিন তেল সাধারণত দরিদ্র জনগণই রান্নার কাজে ব্যবহার করে থাকে। গ্যাসের এ মূল্য বৃদ্ধি সাধারণ ও নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগের কারণ হবে। কেন না, খুব অল্পসংখ্যক মানুষই সয়াবিন তেলের বিকল্প হিসেবে সরিষা বা অন্য কোনো তেল ব্যবহার করে থাকেন। তাছাড়া সয়াবিনের বাইরে অন্যান্য তেলগুলোর দাম আরো বেশি। রোজার মাসেও বাজারে কৃত্রিমভাবে ভোজ্য তেলের সংকট তৈরি করা হয়েছিল। বাজার মনিটরিং টিমগুলোর তৎপরতায় সে সংকট অনেকটা হ্রাস পেয়েছিল। সয়াবিন নিয়ে সে তুঘলকি কর্মকাণ্ড চলছে তা মূলত অসাধু কিছু ব্যবসায়ীর অতি মুনাফালোভী নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। তাদের অনেকেই সয়াবিন তেল মজুদ করে রেখেছেন। আবার তেলের উৎপাদক মূল কোম্পানির বিরুদ্ধেও তেল সংকট তৈরির অভিযোগ রয়েছে।
এমতাবস্থায় বাজারে যদি আদৌ তেলের কোনো সংকট থাকে তাহলে তত্ত্বাবধান, মনিটরিং ও তদন্তের মাধ্যমে নেপথ্যের কুশীলবদের পাকড়াও করে জনগণের জন্য স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতি তৈরিতে সরকারের ভূমিকা রাখা উচিত। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে যদি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হয় তাও লিটার প্রতি ১৪ টাকা, তাহলে জনগণের ওপর তা বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা জানিয়েছেন, সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্ত সাময়িক। এ প্রেক্ষিতে আমরাও আশা করবো, সরকার খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধির যে কোনো সিদ্ধান্ত এড়িয়ে চলবেন এবং সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যাতে তাদের সাধ্যের ভেতরই খাবার কিনতে পারেন তা নিশ্চিতে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।