পাহাড়ের সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল সে কৈশোরেই। শিক্ষা সফরে রাঙ্গামটি গিয়েছিলাম শিক্ষকদের সাথে। পাহাড়ের পাদদেশে মানুষের বসবাস। পাহাড় এমনিতে খুবই সুন্দর। পাহাড়ের সৌন্দর্যের সাথে যখন মানুষের সহজ-সরল ও অনাড়ম্বর জীবন মিশে যায়, তখন আর চোখ ফেরানো যায় না। পাহাড় নিয়ে ভাবতে গেলে এখনো রোমান্টিক হয়ে যাই। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে অনেক ঘটনা জেনেছি, নানা প্রতিবেদনও পড়েছি। পাহাড় এখন আর সে সহজ-সরল পাহাড় নেই। আগে পাহাড়ের মানুষগুলো ছিল যেন প্রকৃতিরই অংশ। ওদের জীবন-যাপনের বৈচিত্র্য আমাদের আকৃষ্ট করতো। এসব নিয়ে এখন কথা কম হয়। সে ষাটের দশকের পর পাহাড়ে তো অনেক বেলা বয়ে গেছে। এখন পাহাড়ের রাজনীতি, সন্ত্রাস ও খুনোখুনির বিষয় নিয়েই আলোচনা বেশি হয়। আমাদের কৈশোরের পাহাড়ের সাথে এখনকার পাহাড়ের পার্থক্য অনেক। আগের পাহাড়টা আবার ফিরে পেতে চাই, যেখানে ছিল শান্তি এবং বৈচিত্র্যের ঐক্য। কৈশোরের প্রিয় সে পাহাড়ের পাশে যদি একটা যতি রেখা টেনে দেওয়া যেতো, তাহলে হয়তো বর্তমানের সন্ত্রাসকবলিত পাহাড় থেকে মানুষের মুক্তি মিলতো। এটা কি সম্ভব? পাশে যে মোদির ভারত।

পার্বত্য চট্টগ্রামকে আবার অস্থিতিশীল করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ভারতীয় মদদপুষ্ট সশস্ত্র সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফন্ট (ইউপিডিএফ)। ধর্ষণের নাটক সাজিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানো, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে পাহাড়ে হামলা চালানো এবং অপহরণ ও চাঁদাবজির মতো কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছে ইউপিডিএফ-এর সদস্যরা। উল্লেখ্য, খাগড়াছড়ির এক মারমা কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে সংগঠনটি সম্প্রতি পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলেছিল। বিক্ষোভ, অগ্নিসংযোগ, হামলা ও অবরোধের মত ঘটনাও ঘটে। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, মারমা কিশোরীর স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। ধর্ষণ ঘটনায় করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণের আলামত পরীক্ষায় তিন সদস্যের চিকিৎসকদলের প্রদত্ত প্রতিবেদনে এ তথা জানানো হয়েছে। ঘাগড়াছড়ি ২৫০ শস্যাবিশিষ্ট জেলা সদর হাপসাতালে ওই কিশোরীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। চিকিৎসক দলে ছিলেন-হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ জয়া চাকমা এবং মেডিকেল অফিসার মীর মোশারফ হোসেন ও নাহিদা আকতার। প্রতিবেদনে চিকিৎসকদল জানায়, ওই কিশোরীর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়নি। জোরপূর্বক যৌনক্রিয়ার কোনো চিহ্নও পাওয়া যায়নি। এছাড়া পরীক্ষার সময় তার মানসিক অবস্থাও ছিল স্বাভাবিক। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চিকিৎসকরা সব ধরনের পরীক্ষা শেষে স্বাস্থ্যগত রিপোর্ট জমা দিয়েছেন, যাতে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।

এদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর বিশ্লেষণে বলা হয়, পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পলায়নের পর ভারত পাহাড়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলতে চাইছে। এমন পরিস্থিতিতে পাহাড়ে দায়িত্ব পালন করা সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছেন, পার্বত্যাঞ্চলে অন্তত নতুন আড়াইশ সেনাক্যাম্প স্থাপন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। তাদের যুক্তি, নতুন ক্যাম্প হলে প্রতিটি রুটে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানানো যাবে, অস্ত্রপ্রবাহ বন্ধ হবে এবং চাঁদাবাজি ও অপহরণ বন্ধ করা সম্ভব হবে। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা ক্যাম্প বৃদ্ধি জরুরি। সেনা কর্মকর্তারা মনে করেন, শান্তিচুক্তির পর ক্যাম্প কমে যাওয়ায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করেছে এবং তারা প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপগুলো গত এক বছরে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা চাঁদা তুলেছে। গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, এর মধ্যে ইউপিডিএফ তুলেছে ১০৪ কোটি টাকা। চাঁদা তোলার তালিকায় রয়েছে সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার এবং কৃষি, যানবাহন, কাঠ, বাঁশ খাত। এছাড়া রয়েছে অপহরণ। সশস্ত্র গ্রুপগুলো রাঙ্গামাটি জেলা থেকে ২৪৪ কোটি, খাগড়াছড়ি থেকে ৮৬ কোটি এবং বান্দরবান থেকে ২০ কোটি টাকা চাঁদা তুলেছে। শুধু চাঁদা নয়, অহরণ ও হত্যার মত নিষ্ঠুর কাজেও জড়িত রয়েছে ইউপিডিএফ। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩৩২ জনকে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটি অপহরণ করেছে বলে জানায় জাতীয় গণমাধ্যম। কিছু পাহাড়ীও অপহরণের শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ অপহরণের শিকার হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থী। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত তাদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৮৯ জন। এদের মধ্যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন সেনাবাহিনীর সদস্যও। নিহত সেনা সদস্যের সংখ্যা ১৬। অন্যদের হত্যার প্রধান কারণ রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও দ্বন্দ্ব। উল্লেখ্য, ইউপিডিএফ এবং তাদের সহযোগীরা ভারতের মিজোরামে স্থাপিত ক্যাম্প থেকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে বাংলাদেশের ভেতরে নাশকতা চালাচ্ছে। সেনা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকায় দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রয়োজন নতুন ক্যাম্প স্থাপন। বর্তমানে খাগড়াছড়িতে ৯০, রাঙ্গামাটিতে ৭০ এবং বান্দরবানে ৫০টি ক্যাম্প থাকলেও, পাহাড়ের ভৌগোলিক বাস্তবতায় এ ২১০টি ক্যাম্প যথেষ্ট নয়। সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে আরো অন্তত ২৫০টি নতুন ক্যাম্প স্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে।

সেনা সদর বলছে, শেখ হাসিনার আমলে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর প্রতি নমনীয় থাকার অলিখিত নির্দেশ ছিল, যার ফলে সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক মদদ ও প্রশাসনিক শৈথিল্য কাজে লাগিয়ে শক্তিশালী হয়। কিন্তু বর্তমান নীতি হলো, ‘নো কম্প্রোমাইজ’। অর্থাৎ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কোনো ধরনের আপস বা আলোচনার সুযোগ নেই। সরাসরি অ্যাকশনই একমাত্র পথ। কারণ, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না; তারা পাহাড়ি ও বাঙালিÑ উভয় জনগোষ্ঠীকেই জিম্মি করে রেখেছে। খাগড়াছড়ি জোনের দায়িত্বে থাকা একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল বলেন, যেভাবে মিথ্যা ধর্ষণের নাটক সাজানো হলো, সামনে হয়তো আরো বড় কোনো ঘটনা ঘটতে পারে। এ ধরনের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে সেনাদের দ্রুত উপস্থিতি জরুরি। কিন্তু বিস্তীর্ণয় পাহাড়ি এলাকার অনেক জায়গায় সেনা ক্যাম্প নেই, ফলে সন্ত্রাসীরা ফাঁকফোকর কাজে লাগায়। তাই আমরা আড়াইশ’ ক্যাম্প স্থাপনের দাবি তুলেছি। বান্দরবানে দায়িত্ব পালন করা একজন মেজর বলেন, ইউপিডিএফ-এর চাঁদাবাজি ও হত্যকাণ্ডের তথ্য আমাদের হাতে আছে। তারা ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যক্ষ সহায়তায় চলছে। প্রতিটি রুট আমরা চিহ্নিত করেছি। এখন প্রয়োজন তাৎক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ। নতুন ক্যাম্পগুলো হলে আমরা এক ঘণ্টার মধ্যে যেকোনো স্থানে অভিযান চালাতে পারবো।

এদিকে সার্বিক বিষয়ে খাগড়াছড়িতে দায়িত্ব পালন করা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, নতুন সেনাক্যাম্প স্থাপনের বিষয়টি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত। আমরা এখন আমাদের যা পুঁজি আছে, সেগুলো দিয়ে নজরদারি করছি। কথিত ধর্ষণের ঘটনাকে পুঁজি করে সাধারণ পাহাড়ি নারী ও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সামনে এগিয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে ইউপিডিএফ। এসব কর্মসূচিতে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের দিয়ে দেশীয় ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করে ফায়ারিং করা হয়েছে। তবে সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখবে। এদিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী তৎপরতা, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড নতুন মাত্রা পেয়েছে। সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার চাইলে কেন আমরা তা প্রত্যাহার করবো? আমরা আমাদের কৌশলে এগিয়ে যাবো।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শাহীদুজ্জামান বলেন, ইউপিডিএফ এবং অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠী ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা থেকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, যা আমাদের জন্য শঙ্কার বিষয়। সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকায় দ্রুত প্রতিক্রিয়া এবং কার্যকর নজরদারি ছাড়া দেশে সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সম্ভব নয়। তিনিও আড়াইশ নতুন সেনাক্যাম্প স্থাপন জরুরি বলে মনে করেন। আসলে এসবের প্রয়োজন হতো না, যদি পাশে মোদির ভারত না থাকতো। বাংলাদেশের বিশাল এলাকাজুড়ে আমাদের সোনালি পাহাড়। পাহাড় আর সমভূমি মিলেই তো বাংলাদেশ। পাহাড়ের মানুষরা আমাদের আপনজন। কিন্তু এখানে বিভক্তির বিষ ছড়ালো কারা? রাজনীতির বিষ, ভাষার বিষ, সাম্প্রদায়িকতার বিষ পৃথিবীর পুরনো বিষয়। এসব বিষের ফলাফর সব সময়ই মন্দ। বিষয়টি পাহাড়ি-বাঙালি সবাইকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে।’ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পরিকল্পনায় কতিপয় সন্ত্রাসীর ষড়যন্ত্রকে আমাদের রুখে দিতে হবে। এ কোনো বিকল্প নেই