নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চলমান শাসনামলে অনেক কিছুই নতুন করে দেখছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে সর্বশেষ উদাহরণটি হলো চলমান বিনিয়োগ সম্মেলন। চারদিনব্যাপী এ বিনিয়োগ সম্মেলনের নাম দেয়া হয়েছে বিজনেস সামিট, যেখানে ৫০ দেশের বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাগণ অংশগ্রহণ করেছেন। ড. ইউনূসের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তারা বাংলাদেশে এসেছেন এবং জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের ব্যবসাবান্ধব অনুকূল পরিবেশ যাচাই করে সেই আলোকে বিনিয়োগ করার আগ্রহ প্রকাশ করছেন।
চারদিনব্যাপী এ সম্মেলন হলেও প্রথম দুদিনে সরাসরি মাঠ ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি যাচাই করেছেন বিনিয়োগকারীরা। আর তৃতীয় দিনে এসে বুধবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একই দিনে তিনি স্টারলিংকের পরীক্ষামূলক ব্যবহারও উদ্বোধন করেছেন। এর মাধ্যমে মহাকাশভিত্তিক কৃত্রিম উপগ্রহের ইন্টারনেটের ব্যবহারে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। সম্মেলনের ফাঁকে গত মঙ্গলবার বিশ্বের ৫৪তম দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সঙ্গে ‘আর্টেমিস চুক্তি’ সই করেছে বাংলাদেশ। ‘আর্টেমিস অ্যাকর্ডস’-হলো যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ ও অসামরিক মহাকাশ অনুসন্ধানকে উৎসাহিত করার একটি বৈশ্বিক উদ্যোগ।
সম্মেলন চলাকালেই জানা গেছে, পাঁচটি বিকাশমান অর্থনীতির জোট ব্রিকসের উদ্যোগে গঠিত নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) বাংলাদেশে আরও এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। এর বাইরে চীন, কোরিয়া, সুইজারল্যান্ড, আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা বিভিন্ন সেক্টরে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এছাড়াও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কয়েকটি বিদেশি ব্যাংক ইতোমধ্যে ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে বাংলাদেশকে। ইতিমধ্যে কয়েকটি বিনিয়োগ গ্রুপ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পাল্টা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য অফিশিয়াল কার্যক্রম শিথিল ও জ্বালানি নীতি তৈরির ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
চারদিনের বিনিয়োগ সম্মেলনের প্রথম দুইদিন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ ও সুবিধা সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। সরজমিন ঘুরে দেখেছেন বিনিয়োগের স্থান ও সুযোগ-সুবিধার বিষয়। বিরাট এ সম্মেলনটি সফলভাবে আয়োজনের নেপথ্যে মূলত কাজ করেছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। এ পদে নিয়োগ পাওয়ার আগে সিঙ্গাপুরে একটি কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন আশিক। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের ডাকে সাড়া দিয়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেশে এসে এরইমধ্যে কর্মদক্ষতার জ্যোতিতে অনেককে ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। বিডা তথা বাংলাদেশকে পরিচিত করিয়েছেন বিশ্বসেরা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে। যার স্বীকৃতি হিসেবে সর্বশেষ তাকে দেয়া হয়েছে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা।
এ বিনিয়োগ সম্মেলনের প্রাপ্তি দৃশ্যমান হবে ভবিষ্যতে ধীরে ধীরে। বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্ববাসীর যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে তাও বদলে যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। যে কোনো বিনিয়োগকারী দেশে-বিদেশে যেখানেই বিনিয়োগের চিন্তা করেন তার বিনিয়োগকৃত অর্থের নিশ্চয়তা। তাকে ভাবতে হয় বিনিয়োগ করতে কত সময় লাগবে, বিনিয়োগের জন্য সরকারের কাছ থেকে যথেষ্ট সহায়তা পাবেন কি না? এ সম্মেলনের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের বিষয়ে একটি ইতিবাচক বার্তা পাবেন।
ফ্যাসিবাদী আমলে এ ধরনের বিনিয়োগ সম্মেলনগুলো হতো বিদেশে। বিরাট বহর নিয়ে বাংলাদেশ থেকে ব্যাংকার, ব্যবসায়ী ও দলীয় কোটার কিছু পেশাদার ব্যক্তি দেশ থেকে যেতেন আয়োজক দেশে। এভাবে মূলত দেশের টাকার অপচয়ই হতো, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এবার সাহস করে দেশেই এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে। এবারের বিনিয়োগ সম্মেলন এরই মাঝে বেশ আশাবাদ জাগিয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকার বাংলাদেশের অর্থনীতিকে তলানিতে নিয়ে গিয়েছিল। বিগত ৮ মাসে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুড়ে দাঁড়াতে শুরু করেছে। আর যদি প্রত্যাশিত বিনিয়োগ দেশে আসে তাহলে দেশ খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, এমনটাই আমরা প্রত্যাশা করি।