বাংলাদেশের রাজনৈতিক যাত্রার এক গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দেশ পৌঁছেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাম্প্রতিক রায় ঘোষণার মাধ্যমে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পতিত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে যে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগগুলো দীর্ঘদিন ধরে জনমনে আলোচিত ছিল, অবশেষে সেসব অভিযোগ বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো এবং আদালত তাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদÐ ঘোষণা করল। এ রায়কে কেবল একটি রাজনৈতিক নেতার পতন হিসেবে দেখা হলে ভুল হবে; এটি আসলে রাষ্ট্রের আইনি কাঠামো, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার এবং জনগণের নিরাপত্তা সংক্রান্ত মৌলিক বিশ্বাসের ওপর রাষ্ট্রের একটি পুনর্নিশ্চিতকরণ।

২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ও অসহযোগের মুখোমুখি হয়ে সরকার যেভাবে রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগ করেছিল তা ছিল চরম মাত্রার মানবাধিকার লঙ্ঘন। ড্রোন ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের অবস্থান শনাক্ত করা, প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়ে গুলি চালানোর নির্দেশ প্রদান, নিরস্ত্র ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ নাগরিকদের ওপর টার্গেটেড হামলাÑএসবই আন্তর্জাতিক আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। আদালতে উপস্থাপিত অডিও রেকর্ড, নির্দেশনা প্রদানকারী কথোপকথন এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের তদন্ত প্রতিবেদন মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ ও অপ্রতিরোধ্য প্রমাণভিত্তিক চিত্র তৈরি হয়, যেখানে পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে এসব অপরাধের কেন্দ্রে ছিলেন সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এ রায় কেবলমাত্র একটি আইনি নথি নয়; এটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার চরম পরিণতি সম্পর্কে একটি সতর্কবার্তাও বটে। আদালত তাদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান, হত্যার নির্দেশ দেওয়া, নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর অপরাধমূলক আদেশ আরোপ এবং বহু নাগরিককে হত্যার দায় নিশ্চিত করে। চানখাঁরপুল ও আশুলিয়ার হত্যাকাÐ, রংপুরের আবু সাঈদের মৃত্যু-এসব ঘটনার প্রতিটি অংশে বিচারিক পর্যবেক্ষণ ছিল অত্যন্ত সুস্পষ্ট। একই সঙ্গে সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনের ক্ষেত্রে আদালত নমনীয়তা দেখিয়েছে-কারণ তিনি সত্য প্রকাশে সহযোগিতা করেছেন। আদালতের এ সিদ্ধান্ত এই বার্তাই দেয় যে বিচারব্যবস্থার উদ্দেশ্য প্রতিশোধ নয়, বরং সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা।

রায় ঘোষণার পর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার দিক থেকেও একটি বিস্ময়কর নীরবতা দেখা গেছে। যে দলটি একটানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল, সে আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে প্রত্যাশিত উত্তেজনা কিংবা তীব্র প্রতিবাদ দেখা যায়নি। বরং দলের উচ্চপর্যায়ের নীরবতা প্রমাণ করে-দলের ভেতরেও শেখ হাসিনার নেতৃত্ব নিয়ে অবিশ্বাস, অস্বস্তি ও বিভাজন তৈরি হয়েছিল অনেক আগেই। দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা কেন্দ্রীভ‚ত ও ব্যক্তিনির্ভর নেতৃত্বের কাঠামো ভেঙে পড়েছে বলেই মনে হয়। তবে এ রায়ের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর বাস্তবায়ন। শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতের আশ্রয়ে অবস্থান করছেন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মৃত্যুদÐবিরোধী অবস্থান ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি জটিল করে তুলতে পারে। তবুও রাষ্ট্রের দায়িত্ব এখানেই শেষ হয়ে যায় না। ন্যায়বিচারের স্বার্থে বাংলাদেশ সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক মহলে বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরা, ভিকটিম পরিবারগুলোর অধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া, এবং ভারতকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে রাষ্ট্রীয় অপরাধে অভিযুক্ত একজন ব্যক্তিকে আশ্রয় দেওয়া আন্তর্জাতিক নৈতিকতার পরিপন্থী। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো-এ রায় যেন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার উপকরণ না হয়ে আইনের শাসনের প্রতীক হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশ বহু বছরই রাজনৈতিক আপস, দায়মুক্তি ও ক্ষমতার দম্ভের খেসারত দিয়েছে। এ রায় সে অস্বাস্থ্যকর রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ভেঙে দিয়েছে। রাষ্ট্র যখন ক্ষমতাসীন ব্যক্তিকে বিচার করতে পারে, তখনই আইন তার প্রকৃত মর্যাদা পায় এবং জনগণ নিরাপত্তার অনুভ‚তি ফিরে পায়। এ রায় আমাদের একটি মৌলিক সত্যের দিকে ফিরিয়ে দেয় আর তাহলো দেশের প্রতিটি মানুষের জীবন, অধিকার ও মর্যাদা রাষ্ট্রের কাছে সমান মূল্যবান। ক্ষমতা কারও হাতেই স্থায়ী নয়; স্থায়ী হলো সত্য, ন্যায় এবং জনগণের সার্বভৌম অধিকার। যত বড়োই কর্তৃত্বশালী বা ক্ষমতাবান হোন না কেন; আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। এই কথাটি শুধু একটি নীতি নয়, বরং একটি সভ্য রাষ্ট্রের অস্তিত্বের ভিত্তি। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রদত্ত মৃত্যুদন্ডের রায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকে আরও দৃঢ় করে দিয়েছে, এবং প্রমাণ করেছে যে অন্যায়ের পথ যত প্রশস্তই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচারই বিজয়ী হয়। সত্য ও ইনসাফই অপরিহার্যভাবে টিকে থাকে।