বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি একসময় জাতির নেতৃত্বের অন্যতম প্রধান উৎস ছিল। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধিকার সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ-প্রতিটি পর্যায়ে ছাত্রসমাজের গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকা ইতিহাসে অম্লান। অথচ সে ঐতিহ্যবাহী ছাত্ররাজনীতি আজ দীর্ঘদিন ধরে এক গভীর স্থবিরতার মুখোমুখি। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদগুলো একে একে অকার্যকর হয়ে পড়েছেÑঅনিয়মিত নির্বাচন, প্রশাসনিক অজুহাত, এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে।
এ প্রেক্ষাপটে সর্বশেষ গত ২৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা নিঃসন্দেহে একটি আশাব্যঞ্জক ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর আগে ২৮ জুলাই রাকসু এবং ২৭ জুন জাকসু নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। তফসিল অনুযায়ী আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু, ১১ সেপ্টেম্বর জাকসু এবং ১৫ সেপ্টেম্বর রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে ছাত্রসমাজ যেসব যৌক্তিক দাবি তুলেছে, তার অন্যতম ছিল নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন। প্রশাসনের এ ঘোষণাকে সে দাবির প্রতি ইতিবাচক সাড়া হিসেবে দেখা যায়।
দীর্ঘ ৩৩ বছর পর জাকসু এবং প্রায় ৩৫ বছর পর রাকসু নির্বাচনের সম্ভাবনা নিছক একটি প্রশাসনিক অনুষঙ্গ নয়; বরং এটি একটি প্রজন্মান্তরের প্রত্যাশা, হতাশা ও আশা-আকাক্সক্ষার বহিঃপ্রকাশ। এত বছর ধরে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ অনুপস্থিত থাকার ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ হারিয়েছে। নেতৃত্ব তৈরির প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মতবিনিময় ও অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলত, ছাত্র রাজনীতি এখন রাজনৈতিক দলের অঙ্গপ্রতঙ্গে পরিণত হয়েছে- যেখানে তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব গড়ে ওঠার পরিবেশ অনুপস্থিত।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত হওয়া উচিত। এটি কেবল একটি মতামত নয়, বরং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাঠামোগত আবশ্যকতা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, রাজনৈতিক সরকারগুলো সাধারণত ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে চায় না। কারণ তারা আশঙ্কা করে যে এতে তারা ক্যাম্পাসে নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। ছাত্রদের মধ্যে থেকে বিকশিত কোনো নতুন নেতৃত্ব হয়তো বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেÑএমন ভয় থেকেই সরকারগুলো বারবার নানা অজুহাতে নির্বাচন এড়িয়ে চলে। এটি গণতন্ত্রের চেতনার প্রতি এক ধরণের অবজ্ঞা।
এ কারণেই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সাধারণ ছাত্রদের একটি বাস্তবিক ও ন্যায্য প্রত্যাশা ছিল যে তারা ক্ষমতায় থাকতেই এসব নির্বাচন দিয়ে যাবে। তাদের হাতে আপাতত এক নিরপেক্ষ প্রশাসনিক সুযোগ রয়েছেÑযেখানে রাজনৈতিক পক্ষপাতের বাইরে থেকে, কেবলমাত্র নীতিনিষ্ঠ উদ্যোগেই নির্বাচনের আয়োজন করা সম্ভব। এ সরকার যদি নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সফলভাবে ডাকসু, জাকসু ও রাকসু নির্বাচন আয়োজন করতে পারে, তাহলে তা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য নয়, পুরো দেশের জন্যই একটি অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। তবে আশঙ্কার জায়গাও আছে। অতীতে দেখা গেছে, যখন কোনো বড় রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন মনে করে যে নির্বাচনে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই, তখন নানা ধরনের রাজনৈতিক চাপ, হুমকি কিংবা প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি করে নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টা চলে। এবারও সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সুতরাং সকল পক্ষকে সতর্ক থাকতে হবে যেন ঘোষিত তফসিল বাস্তবায়নে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র সফল না হয়।
একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক ছাত্র সংসদ নির্বাচন কেবল শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি নির্বাচন নয়, এটি একটি গভীর রাজনৈতিক ও সামাজিক বার্তা। এ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ হবে যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র কেবল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্তরে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমাজের সকল স্তরে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে, তা বিকশিত হচ্ছে। আমরা আশা করি, সরকার, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল এবং বিশ্ববিদ্যালয়সমূহÑসবাই যৌথভাবে এ নির্বাচনের পরিবেশ রক্ষায় অবিচল থাকবে। এর মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্র আরও সুসংহত হবে, নেতৃত্ব গঠনের ধারাবাহিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাবে এবং শিক্ষাঙ্গন ফিরবে তার হারানো প্রাণশক্তিতে।