‘জুলাই বিপ্লব’ নাকি ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’-এ নিয়ে তাত্ত্বিক বিতর্ক আছে। তবে ‘জুলাই’ শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো বিশ্বে দিয়েছে এক নতুন বার্তা। সেটা ফ্যাসিবাদ বিরোধী বার্তা, দেশকে আপন রঙে রাঙিয়ে নেওয়ার বার্তা। জুলাই বাংলাদেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখার সক্ষমতা দিয়েছে। তবে এ স্বপ্ন ধারণ ও বাস্তবায়নের কাজটি বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, রাজনীতির বিষয়টি শুধু নিজ দেশেই আবর্তিত হয় না। ভূরাজনীতি আছে, আঞ্চলিক রাজনীতি আছে, আছে দেশ-বিদেশী ব্যবসায়ী মহলের স্বার্থও। এরমধ্যে আবার প্রবেশ করে সাংস্কৃতিক ও মিডিয়া মহানজনদের এক ধরনের প্রোপাগাণ্ডাওÑ যা অনেক ক্ষেত্রেই দেশ ও জনগণের স্বার্থের অনুকূলে যায় না। ফলে বলতে হয়, জুলাই বিপ্লবের লক্ষ্যে পৌঁছার কাজটি বেশ কঠিন কাজ। ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে যে ঐক্য লক্ষ্য করা গিয়েছিল, তা এখন আর বর্তমান নেই।
সবাই নিজ নিজ রাজনীতি নিয়ে সরব হয়ে উঠেছেন। এতে অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই। তবে রাজনীতি করতে গিয়ে ফ্যাসিস্টদের ভুলে যাওয়া এবং ব্লেমগেমের তীরে পরস্পরকে বিদ্ধ করার ঘটনায় বিস্মিত হতে হয়। এমন চিত্রে আমাদের রাজনীতির দৈন্য ও নীতিহীনতার বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে আমরা ফ্যাসিস্ট সরকারের জুলুম-নির্যাতন, দুর্নীতি, অপশাসন, গুম-খুন ও দেশের স্বার্থ বিসর্জনের মত মহাঅপরাধের কথা ভুলে গেলাম কেমন করে? আমাদের রাজনীতিবিদরা তো এখন এসব নিয়ে তেমন কথা বলেন না। বরং পরস্পরের নিন্দাবাদেই এখন তারা ব্যস্ত। এসব যে রাজনীতি নয়, বরং অপরাজনীতিÑএমন উপলব্ধির জন্য তো কোন গবেষণার প্রয়োজন হয় না, বরং সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। কিন্তু সে কাণ্ডজ্ঞানটা তারা হারালেন কেমন করে? ক্ষমতার স্বপ্ন বা মোহ কি সেই কারণ?
রাজনীতিবিদদের অনেকেই সময়ের দায়িত্ব পালন করতে না পারলেও একটি কর্মে বেশ পারঙ্গমতার পরিচয় দিচ্ছেন, আর তা হলো ইউনূস সরকারের নিন্দাবাদ। ব্যর্থতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে কোনো সরকারই মুক্ত নয়। ইউনূস সরকারেরও ব্যর্থতা আছে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হলো, কোন পরিস্থিতিতে এ অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলো? খুব সাজানো-গোছানো ও সুশৃংখল পরিস্থিতিতে কি ইউনূস সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলো? ফ্যাসিস্ট সরকারের সাজানো প্রশাসন নিয়েইতো এ সরকারকে যাত্রা শুরু করতে হয়েছিলো। ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে যাবার সময় দেশের আইন-আদালত, প্রশাসন, পুলিশ, ব্যাংক, শিল্পÑকোনো কিছুই তো স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল না। এমন বাস্তবতায় দেশ পরিচালনা বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে উঠেছিল। সে চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করে ইউনূস সরকার দেশকে অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। তবে এখনো গুরুত্বপূর্ণ অনেক করণীয় রয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে সংস্কার, বিচার এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। এ পরীক্ষায় ইউনূস সরকার কতটা সফল হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
জুলাই বিপ্লবকে ব্যর্থ করার প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে দেশের ভেতরে এবং বাইরে থেকেও। বিপ্লবের পরপরই সংখ্যালঘু নির্যাতনের একটা প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছিল ভারত থেকে। এ প্রোপাগান্ডায় শুধু বিজেপি নয়, ভারতীয় মিডিয়াও যুক্ত হয়েছিল। এটা ছিল বাংলাদেশের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সফল হয়েছে বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণ। বিষয়টি নিয়ে এখনও আলোচনা হচ্ছে। ভূরাজনীতির এক জটিল পরিস্থিতি তখন মোকাবেলা করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হলেও অর্থনীতি ও ভূরাজনীতির নান বিষয় নিয়ে ভাবতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে ‘বেঙ্গল ডেল্টা কনফারেন্সে ২০২৫-এ’। ২৯ আগস্ট সকালে রাজধানী ঢাকার একটি হোটেলে দুই দিনের এ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। আয়োজক ছিল গবেষণা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিকস (দায়রা)। সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘বাংলাদেশ এ্যাটক্রস রোডস : রিথিঙ্কিং পলিটিকস, ইকোনমিকস, জিওপলিটিক্যাল স্ট্যাটেজি’ (সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ : রাজনীতি, অর্থনীতি ও ভূরাজনৈতিক কৌশল নিয়ে নতুন ভাবনা)। এ সম্মেলনে ‘মিডিয়া রিউমার অ্যান্ড ন্যারেটিভ : পোস্ট জুলাই বাংলাদেশ ইন দ্য সাউথ এশিয়ান ফ্রেম’ (গণমাধ্যম, গুজব ও বয়ান : দক্ষিণ এশিয়ার কাঠামোয় জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশ) শিরোনামের বিশেষ অধিবেশনে বক্তব্য পেশ করেন ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়ার-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সিদ্ধার্থ ভারাদারাজান। তিনি জুলাই বিপ্লবের আগে-পরে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক, জুলাই বিপ্লব নিয়ে ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাড়ানো গুজব, ভারতীয় গণমাধ্যমের অবস্থান, হিন্দুদের ওপর সহিংসতা ইত্যাদি বিষয়ে মন্তব্য করেন। সিদ্ধার্থ ভারাদারাজান বলেন, ভারতের সরকারগুলো এমন ধারণা গ্রহণ করেছিল যে, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকাই ভারতের জন্য সবচেয়ে ভালো। মনমোহন সিং থেকে শুরু করে নরেন্দ্র মোদির আসলÑ ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার বিষয়ে স্বস্তি বোধ করতেন। তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন যাতে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেন। সিদ্ধার্ত্থ বলেন, মোদি সরকার মনে করতো যে, শেখ হাসিনাই ভারতের জন্য সবচেয়ে ভরসার জায়গা। বিনিময়ে শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ কিছু শিল্পপতিকে, যেমন আদানি গ্রুপ। শেখ হাসিনা সরকারের পতন নিয়ে সিদ্ধার্থ বলেন, প্রথম ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশ থেকে আসা সব দৃশ্য ছিল শেখ হাসিনার পতন উদযাপন নিয়ে। একই সঙ্গে শিশুহত্যা, ছাত্রহত্যা ইত্যাদি ঘটনার খবরও আসছিল। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা পার হতেই ভারতীয় গণমাধ্যমে খবর আসতে শুরু করল যে, বাংলাদেশে ব্যাপক দাঙ্গা চলছে, হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে, মন্দির ভাঙা হচ্ছে, গণহত্যা চলছে। এজন্য ভুয়া ফুটেজ ছড়ানো হয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করা হয়েছে। সিদ্ধার্থ ভারদারাজান বলেন, ভারত সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে এ গুজব ছড়ানোর বিষয়গুলো চালু রাখতে দিল। তার মতে, এমনভাবে গুজব ছড়ানো হলো যে, তা মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে চলে গেল। জুলাই বিপ্লবকে ‘হিন্দুবিরোধী ষড়যন্ত্র’ হিসেবে তুলে ধরার মধ্যে বিশেষ রাজনৈতিক বার্তা ছিল। কেউ বলল পাকিস্তান করেছে, আবার কেউ বলল জামায়াতে ইসলামী করেছে। তাই এটা শুধু মোদি সকারের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতাকে আড়াল করেনি, এটি ভারতের অভ্যন্তরেও মানুষকে আরও বিভক্ত করার কাজ করেছে। সিদ্ধার্থ বলেন, সামগ্রিকভাবে ভারত সরকার এ বয়ানেই খুশি ছিল। কারণ, এটি মোদির পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা থেকে মানুষের মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছিল।
দ্য ওয়ারের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সিদ্ধার্থ ভারদারাজানের বক্তব্য থেকে উপলব্ধি করা যায়, বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার ‘জুলাই বিপ্লব’ কতটা কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। জুলাই বিপ্লব বিরোধী গুজবকে ছড়িয়ে দেওয়ার নীতি অবলম্বন করেছে ভারতের মোদি সরকার। এজন্য ভুয়া ফুটেজও ছড়ানো হয়েছে। জুলাই বিপ্লবকে ‘হিন্দুবিরোধী ষড়যন্ত্র’ হিসেবে তুলে ধরার মাধ্যমে বিশেষ রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সে প্রচেষ্টা কি থেমে গেছে, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা কী মনে করেন? ভারতের মোদি সরকার বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লবকে স্বাগত জানায়নি, বরং এ বিপ্লবকে ষড়যন্ত্র বলেই বিবেচনা করছে এখনো এ কারণেই হয়তো পতিত হাসিনা ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের ভারতে আশ্রয় দিয়ে রেখেছেন। তারা সেখানে বসে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছেন ফ্যাসিবাদী হাসিনা গং। সে ষড়যন্ত্রের ননা আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে বাংলাদেশে। ডাকসুসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন এতটা কঠিন হয়ে উঠছে কেন? ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনও সহজ হয়ে উঠবে বলে মনে হয় না। মোদি সরকারের রাজনৈতিক বার্তা বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি উপলব্ধি: করা যায়। প্রশ্ন হলো, আমাদের রাজনীতিবিদরা তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হচ্ছেন কী? নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে, কিন্তু তা যেন প্রতিহিংসায় রূপান্তরিত না হয়। কারণ, প্রতিহিংসা দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিতেও কুষ্ঠি হয় না।