জুলাই গণঅভ্যুত্থান এক বছর পূর্ণ করেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনা করেছিল যে অভ্যুত্থান, তা আজ আর কেবল একটি রাজনৈতিক পালাবদলের দিন নয়Ñএটি হয়ে উঠেছে একটি রাষ্ট্রীয় চেতনার জন্মদিন। গণমানুষের ক্ষোভ, বঞ্চনার অভিজ্ঞতা এবং অব্যাহত নিপীড়নের বিরুদ্ধে আত্মপ্রকাশের যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল, তা শুধু একটি সরকার পতনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং সে বিস্ফোরণ জন্ম দিয়েছে নতুন রাষ্ট্র নির্মাণের প্রত্যয়, যে রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে ন্যায়, সাম্য, গণতন্ত্র ও জনগণের ক্ষমতায়ন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের তাৎপর্য কেবল শাসনব্যবস্থার রদবদলে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘকাল ধরে জমে থাকা জনঅসন্তোষের বৈপ্লবিক বহিঃপ্রকাশ। এ আন্দোলনে ছাত্র, শ্রমিক, দিনমজুর, পেশাজীবী থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণÑসমাজের প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষ ছিল সক্রিয়। এঁদের অনেকেই শহীদ হয়েছেন, কেউবা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, কেউ দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। তাদের আত্মত্যাগ আমাদের ইতিহাসের পুঁজি, যার উপর দাঁড়িয়ে আগামী বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে।

এ অভ্যুত্থানের প্রধান অর্জন ছিলÑএকটি ফ্যাসিবাদী, দুঃশাসনপ্রবণ, দুর্নীতিগ্রস্ত ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ। ভোটাধিকার হরণ, গুম-খুন-অপহরণ, বিচারহীনতা ও রাষ্ট্রীয় দমননীতির বিরুদ্ধে এই অভ্যুত্থান ছিল মুক্তির সূচনা। জনগণের প্রবল ইচ্ছার প্রকাশ ছিল এ যে, তারা আর আগের বাংলাদেশে ফিরতে চায় না। তারা চায় একটি নতুন বাংলাদেশÑযেখানে রাষ্ট্র ক্ষমতা থাকবে জনগণের হাতে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে এবং দুর্নীতির বদলে জবাবদিহিতা হবে রাষ্ট্রযন্ত্রের মূলনীতি।

জুলাইয়ের শহীদরা যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, এর অনেকগুলোই এখন বাস্তবায়নের পথে। রাষ্ট্রীয় সংস্কার শুরু হয়েছেÑপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে নির্বাচনব্যবস্থা পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি খাতে নতুন ভাবনায় পুনর্গঠনের উদ্যোগ চলছে। এসব সংস্কার শুধু পুরনো ব্যবস্থার পরিবর্তন নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি সুশাসনের ভিত্তি রচনা। শহীদদের স্মৃতি রক্ষা এবং আহত-অক্ষম হয়ে পড়া যোদ্ধাদের পুনর্বাসন রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। একইসঙ্গে এ গণঅভ্যুত্থানকে ন্যায্যতা দিতে তাদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাও অপরিহার্য। এ ন্যায়বিচার কেবল বিচারিক প্রক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়, বরং সেটি যেন রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে শহীদদের স্বপ্ন ও মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় হলোÑগণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া। শুধু নির্বাচন আয়োজন করাই নয়, বরং তা হতে হবে সকলের অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও নিরপেক্ষ। যে নির্বাচনে কেউ বাদ পড়বে না, কারো ওপর দমন-পীড়ন থাকবে না এবং যা হবে সত্যিকার অর্থে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। গতকাল ৫ আগস্ট যখন জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস পালিত হয়েছে, তখন শুধু স্মরণ নয়, প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করার দিন এটিÑএকটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত, মানবিক বাংলাদেশ গড়ার সংকল্প পুনরায় দৃঢ় করার দিন। ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে এমন একটি পথে এগিয়ে নিতে হবে, যেখানে স্বাধীনতা ও অধিকার শুধু কাগজে থাকবে না, বাস্তবেও পরিপূর্ণভাবে প্রতিফলিত হবে।

এ অর্জন ধরে রাখা সহজ নয় এবং এ পথ সুগমও নয়। তবু জাতির সবচেয়ে বড় শক্তিÑতার জনগণ। জনগণের ত্যাগ, প্রত্যয় ও সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের অঙ্গীকার হোকÑআর কোনো স্বৈরাচার নয়, আর কোনো ফ্যাসিবাদ নয়। এবার গন্তব্যÑএকটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক বাংলাদেশ।