নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবশেষে সংবিধানে ফিরে এল। এটা ছিল জনমানুষের দাবি। স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার জনমত উপেক্ষা করে বাতিল করেছিল এ ব্যবস্থা। আশার কথা আগামী নির্বাচন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে।

গতকাল দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বহুল আলোচিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে ফিরলো। আগামী নির্বাচন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। পরবর্তী চর্তুদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কার্যকর হবে। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় অবৈধ ঘোষণা করেছেন। একইসঙ্গে ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধ ঘোষণা করে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করেছেন। সেই সাথে এ ব্যবস্থা চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে কার্যকর করার নির্দেশনাও দিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ ঐতিহাসিক এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অপর ৬ বিচারপতি হলেনÑ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। রায় ঘোষণার সময় আইনজীবী ও গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতিতে আপিল বিভাগের এজলাস কক্ষ কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। এ রায়ের মাধ্যমে সংবিধানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরলেও আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে। পরবর্তী অর্থাৎ চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যকর হবে বলে রায়ে বলা হয়েছে। বিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হবেন সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি। তবে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান কে হবেন তা পরবর্তী সংসদে নির্ধারণ করার সুযোগ আছে বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন। এর আগে গত ১১ নভেম্বর নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরানোর আপিলের শুনানি শেষ হয়। এ বিষয়ে রায় ঘোষণার জন্য ২০ নভেম্বর দিন ধার্য করা হয়। টানা ১০ দিন শুনানি শেষে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ঐতিহাসিক এ মামলার রায়ের দিন ঠিক করেন। গত ২২, ২৩, ২৮ ও ২৯ অক্টোবর এবং ২, ৪, ৫, ৬ ও ১১ নভেম্বর এ মামলার আপিলের ওপর টানা শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আপিল বিভাগ বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের অতীতের রায় ছিল কলঙ্কিত ও একাধিক ত্রুটিতে ত্রুটিপূর্ণ। পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়েছে, আদালত এ মর্মে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন- পর্যালোচনাধীন আপিল বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়টি নথিদৃষ্টে স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান একাধিক ত্রুটিতে ত্রুটিপূর্ণ। এ কারণে আপিল বিভাগের অতীতের রায়টি সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা হলো। এর ফলে ফলশ্রুতিতে সংবিধানের চতুর্থ ভাগের পরিচ্ছেদ ২(ক)-এর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সম্পর্কিত বিধানাবলী, যা সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬ (১৯৯৬ সনের ১ নং আইন) এর ধারা ৩ দ্বারা সন্নিবেশিত হয়েছিল, তা এই রায়ের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করা হলো। রায়ে বলা হয়েছে, যদিও এরূপ পুনরুজ্জীবন পরিচ্ছেদ ২(ক)-এ বর্ণিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত বিধানাবলীর স্বয়ংক্রিয় পুনঃস্থাপন নিশ্চিত করে, তবে পুনরুজ্জীবিত অনুচ্ছেদ ৫৮(খ)(১) এবং অনুচ্ছেদ ৫৮(গ)(২)-এর বিধানাবলীর প্রয়োগ সাপেক্ষে তা কার্যকর হবে। রায়ে আরও বলা হয়েছে, পুনঃস্থাপিত ও পুনরুজ্জীবিত পরিচ্ছেদ ২(ক)-এ বর্ণিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত বিধানাবলী কেবলমাত্র উক্তরূপ ভবিষ্যৎ প্রয়োগযোগ্যতার ভিত্তিতেই কার্যকর হবে।

রায়ের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসায় এখন আর দিনের ভোট রাতে হবে না। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা দেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি সহায়ক ব্যবস্থা হিসেবে ফুল জাজমেন্টে আসবে। আজ থেকে বাংলাদেশের মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারবে। দিনের ভোট রাতে হবে না, মৃত মানুষ এসে ভোট দিয়ে যাবে না। তিনি বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হয়েছিল। হাইকোর্ট এটাকে অসাংবিধানিক বলেছেন এবং এই সংশোধনী অসৎ উদ্দেশ্যে আনা হয়েছিল।

আমরা মনে করি, এ ঐতিহাসিক রায়ের ফলে বাংলাদেশের জনমানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর এটাই মানুষের প্রত্যাশা ছিল। অবশেষে উচ্চ আদালতের রায়ে তা বাস্তবায়ন হলো। আমরা আগেকার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যারা আপীল করেছিলেন সব দল ও পক্ষকে অভিনন্দন জানাই। অভিনন্দন জানাই যারা সর্বসম্মত রায় দিয়ে তাদের অভিপ্রায় বাস্তবায়ন করেছেন সে সব মহান বিচারপতিদেরকে। দেশে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠায় এই রায় ইতিহাস হয়ে থাকবে বলে আমরা মনে করি।