নির্বাচনের আগে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে-জনগণের নিরাপত্তা কোথায়? গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তি হলো একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। কিন্তু এমন একটি নির্বাচন আয়োজন করার পূর্বশর্ত হলো- দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। বর্তমান বাস্তবতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ভয়াবহভাবে হুমকির মুখে পড়েছে। চাঁদাবাজি, খুন-খারাবি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন এবং সাধারণ নাগরিকদের নিপীড়নের অভিযোগ প্রতিনিয়ত সামনে আসছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব শুধু একটি সময়মতো নির্বাচন আয়োজন নয়, বরং এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে প্রতিটি নাগরিক নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্রে যেতে পারেন এবং প্রতিটি রাজনৈতিক দল সমান সুযোগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বর্তমান সময়ে এমন কোনো আস্থাশীল পরিবেশ তৈরি হয়নি বরং দলীয় কোন্দল ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে প্রায়শই হতাহতের ঘটনা ঘটছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে অনাচার করলেও প্রশাসন অনেকক্ষেত্রেই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। এ অবস্থায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব-এমনটা কল্পনাও করা যায় না।
যেখানে সাধারণ মানুষের মধ্যে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা বিরাজ করছে কিংবা প্রতিনিয়তই তারা রাজনৈতিক দলগুলোর পরিচয়ে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য লক্ষ্য করছে কিংবা যখন চাঁদাবাজদের হাতে ব্যবসায়ী ও শ্রমজীবীরা জিম্মি হয়ে পড়ে, তখন গণতন্ত্র একটি মৃত কাঠামো ছাড়া আর কিছুই নয়। এমন অনিরাপদ ও উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে নির্বাচন আয়োজন করলে তা শুধুই আরেকটি ভোট নামের আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়াবে, যার ফলাফল জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হবে না বরং প্রভাবশালীদের কৌশলগত আধিপত্যেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে।
চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। বাজার, পরিবহন, নির্মাণ খাত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তের পাড়ার দোকান-প্রতিটি জায়গাতেই চাঁদাবাজ চক্র সক্রিয়। এদের পেছনে রাজনৈতিক ছত্রছায়া আছে বলেই তারা এতটা বেপরোয়া। প্রশাসনের কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যও এ চক্রের অংশীদার। এদের দমন না করে যদি শুধু নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ততা চলে, তাহলে তা জনগণ ও জুলাই বিপ্লবের প্রত্যাশা পূরণ করতে কখনোই সক্ষম হবে না। হাজারো শহীদদের রক্তত্যাগও তখন বিফলে যাওয়ার উপক্রম হবে। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার একটি নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে পারবে কিনা এরই মধ্যে তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। যেভাবে একটি দলের ক্ষমতায় যাওয়া প্রায় নিশ্চিত করে দেয়া হয়েছে তাতে অনেকেই আশংকা করছে যে, আগামীতেও একটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে-যদি সত্যিই তারা জনগণের আস্থা অর্জন করতে চায়, তবে প্রথম কাজ হওয়া উচিত দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি। এটি কোনো রাজনৈতিক দলের দাবি নয়, বরং দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার।
সামনের দিনগুলো বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে, মতপার্থক্য থাকবে-এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। কিন্তু সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেন সংঘাত ও সহিংসতায় রূপ না নেয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই এখন মূল কাজ। সুশাসন ও নিরাপত্তাহীনতা একসঙ্গে চলতে পারে না। আর যারা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে একতরফা নির্বাচন চাপিয়ে দিতে চায়, তারা আসলে গণতন্ত্র নয়-ক্ষমতার অপব্যবস্থাই কায়েম করতে চায়।
তাই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রথম শর্ত হিসেবে এখনই দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো অত্যন্ত জরুরি। প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রেখে নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করতে হবে। চাঁদাবাজ ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযানে কোনো রাজনৈতিক বিবেচনা যেন কাজ না করে। নির্বাচনের পরিবেশ কেবল তখনই গড়ে উঠবে, যখন জনগণ বিশ্বাস করতে পারবে-তাদের ভোটে সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন সম্ভব। সেই আস্থা ফেরাতে হলে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই।