বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের শাহাদাতের ৬ বছর পার হলো। আবরারের শাহাদাত বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর গভীর রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় মেধাবী আবরারকে- শুধু এ কারণে যে, সে সাহস করে বলেছিল বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ভারতীয় আধিপত্যবাদকে মেনে নেওয়া যায় না। তাই প্রতি বছর যখনই তার শাহাদাতের দিনটি আসে তখন আমরা শুধু একটি ব্যক্তির মৃত্যু নয়, বরং একটি যুগের বিবেকের জাগরণকে স্মরণ করি।

আবরার ফাহাদ কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন চিন্তাশীল, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ তরুণ, যিনি রাষ্ট্রের স্বার্থে, সীমান্তের মর্যাদায়, পানিসম্পদ ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে নির্ভীকভাবে মত প্রকাশ করেছিলেন। তার সে অবস্থানই তাকে শহীদ করেছে; কিন্তু সে শাহাদাত আজ কোটি তরুণের অনুপ্রেরণা। জীবিত আবরারের চেয়েও শহীদ আবরার ফাহাদ আজ অনেক বেশি শক্তিশালী, কারণ তার রক্ত নতুন প্রজন্মকে শিখিয়েছে কীভাবে অন্যায় ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে কলম ও কণ্ঠ উঁচু করতে হয়।

তার শাহাদাত শুধু বুয়েট নয়, গোটা জাতির জন্য ছিল এক জাগরণ। তরুণ সমাজ বুঝেছিলÑ দেশপ্রেম কোনো স্লোগান নয়, এটি দায়িত্ব। ভারতীয় আধিপত্যবাদ যেভাবে আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও নীতিনির্ধারণের প্রতিটি স্তরে প্রভাব বিস্তার করেছে, আবরারের লেখনী সে বাস্তবতাকে সাহসিকতার সঙ্গে উন্মোচন করেছিল। তার কণ্ঠ রোধ করতে হত্যাকারীরা ভেবেছিল ভয় ছড়িয়ে দেওয়া যাবে, কিন্তু ফল হয়েছে উল্টোÑতার রক্তে তৈরি হয়েছে প্রতিরোধের আগুন, স্বাধীন চিন্তার মশাল। আবরার ফাহাদ শারীরিকভাবে না থাকলেও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেপথ্যে বারুদ হয়ে কাজ করেছেন; পুরো প্রজন্মকে জাগিয়ে তোলার মশাল হয়ে টিকেছিলেন পুরোটা সময়।

আজ ছয় বছর পরও বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়নি, যা আমাদের রাষ্ট্রীয় দুর্বলতার বেদনাদায়ক প্রতিচ্ছবি। অন্যদিকে, যেভাবে আধিপত্যবাদী শক্তি বাংলাদেশে তাদের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তার করছে, তা আরও শঙ্কাজনক। নদী, বন্দর, বিদ্যুৎ, ট্রানজিটÑ প্রতিটি খাতে একতরফা চুক্তি, অসম বাণিজ্য ও সীমান্তে লাগাতার হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করছে, আবরারের আশঙ্কা কতটা সত্য ছিল।

এ বাস্তবতায় প্রয়োজন জাতির নতুন করে আত্মসমালোচনা ও ঐক্যবদ্ধ অবস্থান। আধিপত্যের কাছে নতি স্বীকার নয়, বরং মর্যাদার সঙ্গে দাঁড়িয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আবরারের শাহাদাত আমাদের সে পথ দেখিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যাম্পাস, রাজনীতিÑ সবখানে তার চেতনা হতে পারে ন্যায়ের সংগ্রামের অনুপ্রেরণা। আবরার ফাহাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হলে আমাদের তার আদর্শে ফিরে যেতে হবেÑ দেশপ্রেম, সত্যের পক্ষে অবস্থান ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্ভীক কণ্ঠ। স্বাধীনতার ৫০ বছরের প্রাপ্তি তখনই পূর্ণতা পাবে, যখন বাংলাদেশের কোনো তরুণ আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজের প্রাণ হারাবে না; যখন এ দেশ তার সীমান্ত, সম্পদ ও মর্যাদায় সত্যিকারের স্বাধীন হবে।

আবরার ফাহাদ শহীদ হয়েছেন; কিন্তু তার ভাবনা বেঁচে আছে কোটি তরুণের হৃদয়ে। তার আত্মত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়Ñ দেশপ্রেম কোনো অপরাধ নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলা কোনো বিদ্রোহ নয়, বরং এটাই প্রকৃত স্বাধীনতার শর্ত। তাই আবরার ফাহাদের শাহাদাতকে সামনে রেখে আমাদের অঙ্গীকার হোক, ভারতীয় আধিপত্যবাদসহ সব প্রকার আগ্রাসন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। কারণ নীরবতা মানে আত্মসমর্পণ আর প্রতিরোধ মানেই জীবন। আবরার ফাহাদের রক্তের ঋণ আমরা শোধ করতে পারব না, তবে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নই হবে শ্রদ্ধার প্রকৃত প্রতিদান।