চলতি অর্থবছরের (২০২৫-২০২৬) প্রথম ষাণ¥াসিকের জন্য প্রণীত মুদ্রানীতি চারিত্রিক বৈশিষ্টের দিক থেকে নিশ্চিতভাবেই সংকোচনমূলক। মুদ্রানীতিতে বিগত তিন বছরের বেশি সময় ধরে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সহজ কৌশল হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট না কমানোর নীতি অব্যাহত রাখা হয়েছে। আমাদের মতো দেশের শুধু মুদ্রানীতির মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হবে না বরং ত্রুটিযুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনা এবং সাপ্লাই চেইনের অসঙ্গতির কারণেই বাজারে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়। অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন, নতুন মুদ্রানীতিতে হয়তো পলিসি রেট কমানোর উদ্যোগ নেয়া হবে। কিন্তু তাদের সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। পলিসি রেট ১০ শতাংশ বহাল রাখা হয়েছে।

গত এক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কয়েকবার পলিসি রেট বৃদ্ধি করেছে। অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, কোনো দেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রবণতা সৃষ্টি হলে অন্যান্য ব্যবস্থার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারে অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণ করে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বাড়লে সিডিউল ব্যাংকগুলো ব্যাংক ঋণের সুদের হার আনুপাতিকভাবে বাড়িয়ে দেয়। এতে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ আগের চেয়ে ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। সেই অবস্থায় সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের আগ্রহ কমে যায়। ফলে এক সময় উচ্চ মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির হার ৪০ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করে ৯ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হলে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফেড) বারবার পলিসি রেট বাড়াতে থাকে। এতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়ে যায়।

অর্থনীতিতে স্থবিরতার ঝুঁকি নিয়েও ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা এই উদ্যোগ নিয়েছিল। বিশ্বের অন্তত ৭৭টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক পলিসি রেট বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং অধিকাংশ দেশই এতে সফল হয়। সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংকও বারবার পলিসি রেট বৃদ্ধি করে। আগে যেখানে পলিসি রেট ছিল ৫ শতাংশ এ পর্যায়ে তা ১০ শতাংশে উন্নীত হয়। কিন্তু বছরখানেক আগেও বাংলাদেশ ব্যাংক সিডিউল ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯শতাংশে ফিক্সড করে রেখেছিল। এতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার তুলনামূলক সস্তা হয়ে পড়ে। সরকার সমর্থক এক শ্রেণির ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অর্থ বের করে নেয়। এক মুদ্রানীতি বাস্তবায়নকালে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি নির্ধারিত ছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। একই সময় ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ সে সময় শিল্পের কাঁচামাল এবং ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি ব্যাপকভাবে কমেছিল। একটি সুবিধাভোগি গোষ্ঠী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা অন্য খাতে প্রবাহিত করেন এবং অনেকেই বিদেশি পাচার করেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করা পর ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশ প্রত্যাহার করে তা বাজার ভিত্তিক করা হয়। বর্তমানে ব্যাংক ঋণের সুদের গড় হার হচ্ছে ১৫ শতাংশ। ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে আসতে শুরু করেছে। বর্তমানে তারল্য সঙ্কটের কারণে এক-চতুর্থাংশ ব্যাংকের ঋণ বিতরণ বন্ধ রয়েছে।

গত বছর জুলাই মাসে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত জুন মাসে তা কমে ৬ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। এটা বিগত ২২ বছরের মধ্যে ব্যক্তিখাতে সর্বনিম্ন ব্যাংক ঋণ প্রবাহ। আর্থিক সঙ্কটে পতিত হয়ে দেশের অনেক স্থানে শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আরো আগেই যদি বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজার ভিত্তিক করতো তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারতো। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি কিছুটা মন্থর গতিতে হলেও কমতে শুরু করেছে। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করেন,মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নেমে এলেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় দেশের অর্থনীতি দীর্ঘস্থায়ী মন্দার কবলে পড়তে পারে। এ মুহূর্তে শুধু মূল্যস্ফীতি কমানোর উপর জোর দেয়া হলে ভুল হবে। আমাদের বিনিয়োগ এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঠিক রাখার জন্যও চেষ্টা চালাতে হবে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত মাত্রায় না হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে না। আর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা না গেলে দারিদ্র্য বিমোচন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্য যেসব টুলস আছে তার সঠিক প্রয়োগ করতে হবে।