॥ হাফসা সারোয়ার রুনি ॥
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সুদক্ষ এবং চৌকস কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমান আল আজমি হঠাৎ করেই নিরুদ্দেশ হয়ে যান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন তাকে তুলে নেয়ার পর আর তার হদিস পাওয়া যায়নি! সুদীর্ঘ আট বছর পর আয়না ঘর নামক বন্দিশালা থেকে তিনি মুক্ত হয়েছেন। স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি আবার পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখতে পেলেন। এ যেন আয়না ঘর থেকে ফিরে আসা জীবনের এক নতুন অধ্যায়।
জীবন গতিময় কিন্তু এখানে ছিলো স্থবিরতা। এমন স্থবিরতা যা আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়! হঠাৎ যখন কেউ নিরুদ্দেশ হয়ে যান, তখন তার পরিবার আপনজন দিশেহারা হয়ে পড়ে। দিনটি ছিল ২০১৬ সালের ২২ শে আগস্ট। মগবাজার কাজী অফিস লেন। রাত বারোটার কিছু বেশি হবে। হঠাৎ এ লেনে ঢুকে পড়ে বেশ কয়েকটি গাড়ি এবং পুরো এলাকার কারেন্ট লাইন কেটে দেয়া হয়। একদল সাদা পোশাকধারী লোক কোন নাম পরিচয়হীনভাবে তুলে নিয়ে যায় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ‘আমান আল আজমি’কে। কোন প্রকার পরিচয় তাদের জানা গেল না।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এ এক করুণ অধ্যায়।
তিনি ছিলেন চৌকস এক সেনা অফিসার। ব্যাচে-‘সোড অফ অনার’ পাওয়া এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তার একনিষ্ঠ কাজ ও সততার জন্য যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। দেশের প্রয়োজন ছিল এমন একজন সেনা কর্মকর্তার। অধ্যাপক গোলাম আযমের পুত্র হওয়ার কারণে তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হলেন। তাকে গুম করে আয়না ঘরে রাখা হলো সুদীর্ঘ আট বছর। নিরপরাধ এক মানুষ; যিনি জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ছিলেন! মৃত্যুর প্রহর গুনেছেন তিনি দীর্ঘ সময়। যেখানে এক মুহুর্ত বাঁচার নিশ্চয়তা ছিলো না! তিনি যেখানে ছিলেন স্বাভাবিক কোন রুম নয় বরং জানালাবিহীন এক কারা প্রকোষ্ঠে! যেখানে খাবার বা বেঁচে থাকার কোন নিশ্চয়তা ছিলো না! বহু বছর সূর্যের আলো বাতাস থেকে বঞ্চিত ছিলেন। দু’হাত এবং চোখ বেঁধে ওয়াশরুমে নেয়া হতো। কাগজ চেয়েছিলেন, সুদীর্ঘ সময় লিখেছিলেন অনেক কিন্তু কিছুই আনা হয়নি। কেবল জীবন নিয়ে ফিরে এসেছেন। যাকে ফিরে পাওয়ার আশা ছিল প্রায় ক্ষীণ। তবে ইতিহাসের এক আশ্চর্য পরিবর্তনে তিনি ফিরে এলেন। এ যেন প্রকৃতির এক রিভেঞ্জ! স্রষ্টার প্রতিশোধ! পৃথিবীর তাবৎ দার্শনিকরা যা মিলাতে পারেননি। একদিন আগেও মানুষ যা চিন্তা করেনি। পরাক্রমশালী মহাপ্রভু মজলুমের ফরিয়াদ এভাবেই কবুল করেন।
পুরো বাসা আত্মীয় পরিজনের ঠাসা। ‘মা’ হারানোর বেদনায় ছোট খালাকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদছেন। এ দীর্ঘ সময়ে অনেককে হারাতে হয়েছে। স্ত্রী-সন্তানদের জীবনে গিয়েছে কত স্ট্রাগল! ফুপুকে ধরে কাঁদছেন! যেন প্রাণের উপচে পড়া সব বেদনার পুঞ্জিভূত আবেগ।
এভাবে জীবনের অনেক অধ্যায়, অনেক পরিবর্তন এসেছে। তার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে। নিজ জীবনেও তার অনেক পরিবর্তন। বয়স বেড়েছে, স্থিরভাবে সব ধীরে গ্রহণ করছেন। যেন ধাক্কা, বেদনা, আর অভিজ্ঞতায় এক স্থির প্রতিমূর্ত। সেনা কর্মকর্তা ছিলেন বলে অবিচল টিকে থেকেছেন।
জীবনের এ যেন আরেক বাঁক। কত মানুষ হারিয়ে গেছে! কত মানুষের জীবনের অধ্যায় শুরু হয়েছে ! মূল্যবান এ জীবন থেকে যা হারিয়ে যায়, যে সময় চলে যায়, তা কখনো আর ফিরে আসে না। এর ধারাবাহিকতাও খুঁজে পাওয়া কঠিন!
আমরা দোয়া করি, সম্মানিত এ মানুষটির জীবনে ফিরে আসুক অবিরাম গতি এবং প্রাণচাঞ্চল্য। বাকি জীবন হোক সত্য, ন্যায় ও মানবকল্যাণে নিবেদিত। একান্তভাবে সেটি কামনা করছি। লেখক : প্রাবন্ধিক।