মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা অনেকদিন থেকেই একটি ঐতিহাসিক এবং ভূরাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। রোহিঙ্গারা বিশ্বের কোথাও নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পায় না। মিয়ানমারে তাদের পূর্বপুরুষের বসতি থাকলেও তাদেরকে সেখানে পরিকল্পিতভাবে অবাঞ্ছিত করে দেয়া হয়েছে। মূলত সত্তরের দশকের শেষ থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি হয় আর এরই ফলশ্রুতিতে তখন থেকেই বাংলাদেশেও রোহিঙ্গাদের আনাগোনা শুরু হয়।

এরপর নিয়মিত বিরতিতে তাদের আগমন ঘটতে থাকে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিগত সময়ে বেশির ভাগ রোহিঙ্গার নিজ দেশে প্রত্যাবাসন করাতে পারলেও ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা কয়েক দশক ধরে শরণার্থী হিসেবে কক্সবাজারের উখিয়ায় রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে বসবাস করছিল। ২০১৭ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন প্রক্রিয়া শুরু হলে জীবন বাঁচানোর জন্য প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। নতুন করে আসা বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। রোহিঙ্গাদের সামগ্রিক ভরণ-পোষণ দেখাশোনা এবং ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশকেই বহন করতে হচ্ছে।

নির্মম সত্য কথা হলো, আওয়ামী লীগ রোহিঙ্গা ইস্যুতে রাজনীতি যতটা করেছে, কাজের কাজ ততটা করেনি। মোটামুটি হাটেবাজারে সর্বত্রই এমনটা আলোচনা ছিল যে, শেখ হাসিনা নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার খায়েশেই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে নিজেকে বিশ্বের দরবারে মহান নেতা হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতার্থে জাতিসংঘের শরনাপন্ন হয়ে কিংবা প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে গঠনমূলক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কিংবা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে বিগত সরকারের সময়ে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য তৎপরতা চোখে পড়েনি। এখানে আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা ছিল, পাশাপাশি পরিকল্পনাও বাস্তবসম্মত ছিল না। রোহিঙ্গা সমস্যাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরার ক্ষেত্রেও বিগত সরকার ব্যর্থ হয়েছিল।

বিশালসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের ৮ বছর পার হতে চলেছে। বিগত আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও তার নিজ দেশে পাঠানোর মতো অবস্থা তৈরি করা যায়নি। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাটি আমাদের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা হলেও বিগত সময়ে আমরা একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে পারিনি। এতসব ব্যর্থতার মধ্যে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যাকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে বলেই মনে হচ্ছে। এরই মধ্যে উপদেষ্টার মর্যাদায় একজন ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলিসংক্রান্ত হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য একটি ডেডিকেটেড দপ্তর তৈরি হয়েছে, যার প্রধান কাজ হলো রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নিয়ে নিবেদিতভাবে কাজ করে যাওয়া। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কেননা, বিগত সময়ে রোহিঙ্গা সমস্যাটি শুধু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনই দেখা হতো।

এরই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস চার দিনের সফরে বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে তিনি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ইফতার ও মতবিনিময় করেন। এটিও একটি যুগান্তকারী ঘটনা। জাতিসংঘের মহাসচিবের এ সফর রোহিঙ্গা সমস্যাকে বিশ্বদরবারের একটি গুরুত্বের জায়গায় নিয়ে যাবে বলে আশা করা যায়। সফরকালে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সম্প্রদায়কে এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার জন্য আহহ্বান জানান। পরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। সেখানেও তিনি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রধান উপদেষ্টার ইতিবাচক বক্তব্য ও জাতিসংঘ মহাসচিবের সফরের পর রোহিঙ্গারা আস্থা ফিরে পেয়েছে। মাঝখানের বছরগুলোতে নিজ দেশে ফেরার ব্যাপারে তাদের যে অনাগ্রহ তৈরি হয়েছিল, তাও অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। যেকোনো ইতিবাচক ও দূরবর্তী সমাধানের জন্য আস্থা ধরে রাখাটা খুব জরুরি। আপাতত রোহিঙ্গারা দেশে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছেন, আস্থা ফিরে পেয়েছেন -এটিও অনেক বড়ো সফলতা। আশা করি, সরকার ও জাতিসংঘ মিলে সহসাই আরো কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এবং আমরা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার আলো দেখতে পাবো।