আমরা কি আসলে আইয়্যামে জাহেলিয়াত থেকে এক ঝলমলে জাহেলিয়াতে প্রবেশ করলাম? তবে এতে সময় লেগেছে অনেক, প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ’ বছর। জাজিরাতুল আরবে যখন আইয়্যামে জাহেলিয়াত চলছিল, তখন সেখানে কোনো কিছুই সঠিক অবস্থানে ছিল না। যথাবিষয় যথাস্থানে না থাকলে সমাজে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়, তার উদাহরণ আইয়্যামে জাহেলিয়াত। কাবাকে ঘিরে তখন অনাচার হতো, নেতারা ছিলেন কায়েমী স্বার্থের প্রতিভূ। জুলুম-নিপীড়ন, বঞ্চনা, বৈষম্য ছিলো সমাজের সংস্কৃতি। নারীদের কোনো মর্যাদা ছিল না, ফলে মেয়ে শিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। এমন সমাজে শান্তি, সুবিচার ও উন্নয়ন সম্ভব নয়। তবে সমাজে গুণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে তা সম্ভব করে তুলেছিলেন একজন মানুষ। তিনি মোহাম্মদ (স.)। অন্ধকার সমাজকে আলোক প্রভায় প্রাগ্রসর করার জন্যই তো মহান ¯্রষ্টা পৃথিবীতে নবী-রাসূলদের পাঠিয়েছিলেন। শেষ নবী গত হয়েছেন প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ’ বছর আগে। দীর্ঘ এ সময়ে মানুষ পৃথিবীতে নানা কর্মকা- করেছে। এ সময়টায় সমাজ ছিল, রাষ্ট্র ছিল। ছিল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকা-সহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিবিধ তৎপরতা। এসব বিষয়ের সম্মিলনে তৈরি হয়েছে এক নতুন সভ্যতা, এক নতুন বিশ^ব্যবস্থা। ইতিহাসটা কিন্তু সাড়ে চৌদ্দশ’ বছরের।
আইয়্যামে জাহেলিয়াতের পর আমরা শেষ নবীর সোনালী যুগ দেখেছি। এরপর দেখেছি খোলাফায়ে রাশেদীন তথা মহান খলিফাদের শাসন। অতঃপর উমাইয়া, আব্বাসীয় ও উসমানী খেলাফত। উজ্জ্বল আলোকমালা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছিল। সবাইকে কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আপন আপন কর্মের জন্য প্রত্যেককেই জবাব দিতে হবে মহান আল্লাহর কাছে। পৃথিবীটা আসলে পরীক্ষার জায়গা। ফল ভোগের জায়গা হলো পরকাল। ইতিহাসে বিশ^াসীদের তথা ঈমানদারদের যেমন অধ্যায় আছে, তেমনি আছে সেক্যুলার তথা ইহলৌকিকবাদীদের অধ্যায়ও। আমাদের বসবাস এখন এ অধ্যায়ে।
সেক্যুলার অধ্যায়ের সূচনা হয় ইউরোপীয় রেনেসাঁর মাধ্যমে। এই রেনেসাঁর বিকাশকাল ১৪০০ সাল থেকে ১৭০০ সাল পর্যন্ত। ইউরোপীয় রেনেসাঁর ওপর ভিত্তি করে সংঘটিত হয় শিল্পবিপ্লব। ১৮২০ সালে শিল্পবিপ্লব শুরু হয় যুক্তরাজ্যে। মূলত ১৮২০ সাল থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায় শিল্পবিপ্লবের অভাবনীয় বিস্তার। এ বিপ্লবের দাম্ভিক প্রকাশ ঘটে প্রথম বিশ^যুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) এবং দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫)। প্রথম বিশ^যুুদ্ধে পরাজয় ঘটে সে সময়ের বিশাল শক্তি উসমানি খেলাফতের। পরাজয়ের বিবিধ কারণ অবশ্য সৃষ্টি হয়েছিল বেশ আগেই। শিল্পবিপ্লবের ভয়ংকর প্রকাশ লক্ষ্য করা গেছে বিশ^যুদ্ধে। আণবিক বোমা তার এক রূপ। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বর্ষণ করা হয়েছিল ‘লিটল বয়’ ও ‘ফ্যাটম্যান’ নামের দু’টি আণবিক বোমা। মুহূর্তের ধ্বংসযজ্ঞে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে শহর দু’টির নাগরিকরা। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে লাখো নাগরিক। আণবিক বোমার ক্ষতির জের এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে জাপানকে।
দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ শেষ হয়েছে ১৯৪৫ সালে। যুদ্ধের ধ্বংসলীলা লক্ষ্য করে তখনকার বিজয়ী বিশ^নেতারা যেন একটু থমকে গেলেন। বললেন, আর যুদ্ধ নয়। শান্তির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হলো জাতিসংঘ। কিন্তু জাতিসংঘ কি বিশে^ শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হচ্ছে? জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণ কিন্তু বিশে^র বৃহৎ শক্তিবর্গ, যার অপর নাম ‘পরাশক্তি’। তাদের পরাশক্তি হওয়ার ভিত্তি হলো পারমাণবিক মারণাস্ত্র। তাদের আণবিক শক্তি এখন পারমাণবিক শক্তিতে উন্নীত হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো এখন অহংকার করেই বলেন, পৃথিবীকে বহুবার ধ্বংস করার মত পারমাণবিক অস্ত্র মজুত আছে তাদের কাছে। এমন অস্ত্র অবশ্য আরও কিছু দেশের কাছে আছে। এখানে প্রশ্ন হলো, পৃথিবী একবার ধ্বংস হলে, বাকি অস্ত্র ব্যবহার করার মত কোনো বিজ্ঞানী বা দাম্ভিক শাসক পৃথিবীতে বর্তমান থাকবেন কী? তাহলে ভয়ংকর এ অপচয়টা কেন? বর্তমান সভ্যতার শাকদের এমন ভয়ংকর রূপ কেন? আমরা তো ইউরোপীয় রেনেসাঁ দেখলাম, শিল্পবিপ্লব দেখলাম, দেখলাম প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ। এখন দেখছি পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু সংকট, জীববৈচিত্র্যে সংকট। বিজ্ঞানীরা পরিবেশবাদীরা এসব দেখে হা-হুহাশ করছেন। সম্মেলন হচ্ছে, চুক্তি হচ্ছে, কিন্তু সংকটের কোনা সমাধান হচ্ছে না। কথা ও কাজে এ যে গড়মিল, এর কারণ কী? কারণ হলো, কারো কোথাও জবাবদিহিতার ভয় নেই। এর মূলে রয়েছে সেক্যুলারিজম বা ইহলৌকিকবাদিতা। ইউরোপীয় রেনেসাঁ তাদের এমন জ্ঞান দিয়েছে। তারা ভাবছেন হাতে পারমাণবিক বোমা থাকলে আর ভয় কী? অথচ সাম্প্রতিককালে ঝড় ও দাবানল সুনামি ও ভূকিম্পের সময় আমরা তাদের অসহায় অবস্থা দেখেছি। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও পারমাণবিক বোমা তাদের রক্ষা করতে পারেনি। আসলে ‘ইহলৌকিকবাদের জাহেলিয়াত’ তাদের বিভ্রান্ত করে রেখেছে। যারা এখন সভ্যতার শাসক তাদের ধর্মগ্রন্থ তৌরাত এবং বাইবেলে কি পরকালের কথা নেই, জবাবদিহিতার কথা নেই? থাকলে তারা এতোটা বেপরোযা হন কেমন করে?
পাশ্চাত্য এখন প্রোডাক্টিভিটি তথা উৎপাদনশীলতার অহংকারে মত্ত। নৈতিকতামুক্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চায় তারা ব্যাপকভাবে ব্যস্ত। এর মূলে রয়েছে শিল্পবিপ্লব। এ বিপ্লব তাদের ‘পারসুট অব ম্যাটেরিয়ালিজম’-এ প্ররোচিত করেছে। পাশ্চাত্য এখন শুধু টাকার পেছনে ছুটছে, তাদের দেখে অন্যরাও ছুটছে। এখানে ন্যায়-অন্যায়, পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু সংকটের কোনো গুরুত্ব নেই। মানুষ যেন এখন আর কোনো নেতিক প্রাণী নয়। মানুষকে এমন বিভ্রান্তিতে ফেলেছে ইউরোপীয় রেনেসাঁর ‘ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতা’ তত্ত্ব। ধর্ম-দশৃনের নৈতিকাবোধ থেকে যদি সমাজ ও রাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন থাকে, তাহলে মানুষ জবাবদিহিতার চেতনা পাবে কোত্থেকে? মানুষ এখন আসর প্রভুকে অস্বীকার করে নিজেই প্রভু হয়ে বসেছে। তাদের প্রভুত্ব লক্ষ্য করা যায় ভূরাজনীতিতে, অর্থনীতিহতে এবং যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায়। মহান প্রভুতো মানববান্ধব করেই পৃথিবিকে সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু স্বার্থান্ধ ক্ষুদ্র প্রভুরা তো পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে। তাদের ভ্রষ্ট ভাবনার ‘প্রোডাক্টিভিটি’ এর মূল কারণ।
গত সাড়ে চৌদ্দশ বছরের যৎকিঞ্চিৎ বৃত্তান্ত আমাদের কী বার্তা দিচ্ছে? পাশ্চাত্য সভ্যতার ‘প্রোডাক্টিভিটি’ মানব জাতিকে আস্থার সংকটে ফেলেছে, মারণাস্ত্র প্রতিযোগিতা তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করেছে; সৃষ্টি করেছে বৈষম্য, বর্ণবাদ এবং অর্থনৈতিক সংকট ছাড়াও জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্যের সংকট। এমন প্রোডাক্টিভিটি ও সভ্যতা দিয়ে মানুষ কী করবে? এ কারণেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ তার ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে বলেছেন, “পাশ্চাত্য আমাদের ‘শক্তিরূপ’ দেখিয়েছে, ‘মুক্তিরূপ’ দেখাতে পারেনি।” মানুষ যত বড়ই হোন না কেন, সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত নন। সেই সীমাবদ্ধতার রয়েছে নানা রূপ। এখন আমরা সে সীমাবদ্ধতার ভয়ংকর রূপও লক্ষ্য করছি। আসলে মানবমুক্তির প্রকৃত রূপ দেখাতে পারেন মহান ¯্রষ্টা। সে লক্ষ্যেই যুগে যুগে পাঠিয়েছেন হযরত মূসা, ঈসা এবং মোহাম্মদ (সা.)-এর মতো নবী-রাসূলদের। তাঁরাও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণের জন্য ‘প্রোডাক্টিভিটি; তথা উৎপাদনশীলতার কথা বলে গেছেন। তবে সে উৎপাদনশীলতার সাথে যুক্ত ছিল নৈতিকতা ও জবাবদিহিতার চেতনা। প্রসঙ্গ এখানে মোহাম্মদ (সা.)-এর একটি বক্তব্য তুলে ধরা যায়। তিনি জানিয়েছেন, হাশরের ময়দানে আমাদের পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে। ১. জীবন কীভাবে কাটিয়েছো? ২. যৌবন কীভাবে ব্যয় করেছো? ৩. সম্পদ কীভাবে উপার্জন করেছো? ৪. সম্পদ কীভাবে ব্যয় করেছো? ৫. অর্জিত জ্ঞান কীভাবে ব্যবহার করেছো? শেষ নবীর বক্তব্য থেকে উপলব্ধি করা যায়, মানুষের প্রোডাক্টিভিটির ধরন কেমন হওয়া উচিত। এ পাঁচটি প্রশ্ন থেকে মানব সভ্যতার ভিত্তিও তৈরি করা যেতে পারে। সবশেষে এখানে বলার মতো বিষয় হলো সাড়ে চৌদ্দশ বছর পরেও ‘মুক্তিরূপ’ পেতে আমাদের অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে শেষ নবীর পদাঙ্ক।