॥ আবু মহি মুসা ॥

আদি যুগ থেকে বিশে^র অধিকাংশ দেশই অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে চলে আসছে। তার মূলে ছিল অপরাধপ্রবণতা। মানুষ জন্মগতভাবে অপরাধপ্রবণ। এমন অপরাধ প্রবণতার কারণে ব্যক্তিস্বার্থ যখন বড় হয়ে দেখা দেয়, তখন দেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। আমাদের দেশে অপশাসন-দুঃশাসনের ক্ষেত্রে শেখ মুজিবর রহমান এবং তার কন্যা শেখ হাসিনার নাম উল্লেখ করা যায়। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য তারা অযৌক্তিভাবে দেশের মানুষকে হত্যা করেছেন। দেশের সম্পদ লুট করেছেন। শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন এক সময় বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু তার যথেষ্ট দূরদর্শীতার অভাব ছিল। তিনি আজীবন ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেছেন এবং আজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারতেন যদি তিনি দূরদর্শী হতেন। কিন্তু দূরদর্শীতার অভাবই তাকে বাংলাদেশের ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত করেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে তিনি আজীবন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারতেন? বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনে তার অবদানের কথা অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার শুরুটা ছিল আগরতলার ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় তিনি আসামী ছিলেন। অনেকে বলেছেন, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি। তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে। কিন্তু ১৯৭১ সালে ৭ মার্চের ভাষণের সময়ে আ.স.ম. আব্দুর রব বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের জনগণের উপর আক্রমণ শুরু করে। এ সময়ে বঙ্গবন্ধু ভারতে পালিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তিনি পালিয়ে না গিয়ে পাকিস্তানীদের হাতে ইচ্ছকৃতভাবে ধরা দিলেন। তাকে পাকিস্তানে নেয়া হল। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হল। মারা গেল ৩ লাখ মানুষ। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়েও তিনি জানতে পারেননি, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তিনি লন্ডন হয়ে ভারত এবং ভারত হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসলেন ৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। তিনি সত্যি যদি দূরদর্শী হতেন তার উচিত ছিল, রেসকোর্স ময়দানে একটা আখেরি ভাষণ দেয়া। ঠিক একথাগুলো যদি বলতেন, ‘ প্রিয় দেশবাসী, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমি অনেক জেল-জুলুম সহ্য করেছি। আজ দেশ স্বাধীন। স্বাধীনতার অর্জন করা যত সহজ, তার চেয়ে কঠিন হচ্ছে স্বাধীনতা রক্ষা করা। আপনারা দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করবেন। আমি এখন বিশ্রাম নিতে চাই।’ এমন একটি ঘোষণা দিয়ে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খোমেনীর মত ক্ষমতার পর্দার অন্তরালে ক্ষমতাধর হয়ে বিশ্রাম নিতেন পারতেন। তিনি সব দলকে ডেকে নতুন করে নির্বাচন করার পরামর্শ দিতেন। এর মধ্যে কেউ প্রধানমন্ত্রী হতেন, কেউ প্রেসিডেন্ট হতেন। কিন্তু ক্ষমতার মূল কলকাঠি থাকতো তার হাতে। দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো অসঙ্গতি দেখলে তিনি গর্জন করে উঠতেন। গণতান্ত্রিকভাবে দেশে শাসনকার্য পরিচালিত হত। তিনি অলিখিতভাবে দেশের সর্বময় ক্ষমতা অধিকারী হতেন। এর পরের ইতিহাস সবারই জানা। তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরে এসেই রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখলেন। তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে তিনি প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন। পরে তিনি স্বঘোষিতভাবে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হলেন। তিনি প্রথমে বাকশাল গঠন করলেন ইরাকের মরহুম প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের বার্থ পার্টির আদলে। তার এ চিন্তা চেতনার বিরুদ্ধে তখনকার রাজনৈতিক দলগুলো ফুঁসে উঠতে লাগল। ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য ভারতের পরামর্শে সেনাবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে রক্ষিবাহিনী তৈরি করলেন। তার ক্ষমতার মসনদ পাকাপোক্ত করার জন্য তিনি রক্ষীবাহিনীর দ্বারা বিরুদ্ধবাদী রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার কর্মীদের হত্যা করলেন। বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে অনেক লোক না খেয়ে মারা গেল। আগুনে ঘি ঢালা হলে যেমন আগুন দাউ দাউ করে জ¦লে ওঠে, ঠিক তেমনি দেশের জনগণ বিক্ষুব্ধ হলো তার কার্যকলাপে। একই সাথে সেনাবাহিনীও ক্ষুব্ধ হলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট সেনাবাহিনীর হাতে তাকে প্রাণ হারাতে হলো। তার জীবন নিয়ে এমন ইতিহাস সৃষ্টি হবে পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে আসার পর কেউ কল্পনা করতে পারেনি। তার মৃত্যুর পর, আজকে যেমন মন্ত্রীরা কর্মক্ষেত্র থেকে পালিয়েছেন, তেমনি সেই সময়ে অনেক মন্ত্রী তাদের দেহরক্ষীদের বাসায় আত্মগোপন করেছিলেন। তার জীবনে এমন নির্লজ্জ ঘটনা ঘটতে পারে এটা কেউ ভাবতে পারেনি।

একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটালেন তার কন্যা শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের দেয়া ‘রং হেডেড’ খেতাব নিয়ে তিনি বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন। দেশ চালানোর যোগ্যতা শেখ হাসিনার ছিল না। রং হেডেড হওয়ার কারণে, তার মাথায় ভূতচেপে বসার মতো সুযোগ পেল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। স্বাধীনতার প্রাক্কালে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী কামরুজ্জামানের সাথে যে গোপন চুক্তি হয়েছিল, তার পূর্ণ বাস্তবায়ন করলেন শেখ হাসিনা। কত লোককে খুন করেছেন, কত লোককে গুম করেছেন আয়না ঘর বানিয়ে তার হিসাব কিন্তু এখনো জানা যায়নি। যতদিন ক্ষমতায় ছিলেন, তিনি দেশের কী পরিমাণ ক্ষতি করেছেন, তার ঝাঁজ দেশের জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করে নিজে তো দেশের অর্থ লুট করেছেন, তার উদাসীনতার সুযোগে তার দোসররা হাজার হাজার কোটি টাকা কামাই করে নিয়েছেন। এর কী পরিণতি হতে পারে এটা কি আওয়ামী ঘরানার লেস্পেন্সারা কোনো দিনও ভাবতে পেরেছেন? বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরি করেছে। রিজার্ভ কমে যাওয়ার ফলে কোম্পানীর মালিকরা এল.সি. খুলতে না পেরে তাদের কোম্পানী বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এরকম পরিস্থিতিতে উচিত ছিল সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা দিয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়া। অনেকেই বলেছিলেন, এ দীর্ঘ ষোল বছরে শেখ হাসিনা যা করেছেন তাতে বাংলাদেশে তার বাবার কোনো কীর্তি থাকবে না। ইরাকে সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের মুরাল ভেঙে ফেলা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মুরালও ভেঙে ফেলা হবে।’ তাই দেখলাম। তিনি অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতে পালিয়ে গেছেন। পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছিল। তিনি ভারতে গিয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে ভাষণ দিতে শুরু করলেন ‘র’ এর পরামর্শে।

দেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গসংগঠনকে উস্কানী দিতে লাগলেন। বাংলাদেশে অবস্থানরত ‘রং হেডেড’ আওয়ামী লীগের চ্যালা চামু-ারা উজ্জীবিত হয়ে উঠছে। মিছিল, মিটিং শুরু করেছে। তিনি আবার স্বপ্ন দেখলেন তিনি বিজয়িনীর বেশে দেশে ফিরে আসবেন। তার পতনের পর শেখ মুজিবের মুরাল ভাঙা হয়েছে। সম্প্রতি তার শেষ ভাষণে দেশের জনগণ এতটাই ক্ষিপ্ত হয়েছে যে তারা যুদ্ধাংদেহী মনভাব নিয়ে ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটাকে গুঁড়িয়ে দিল। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রীর বাড়ি ভেঙে চুরমার করা হয়েছে। হাসিনার মুখ বন্ধ করার জন্য এ ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না জনগণের কাছে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের বাড়ি যেমন ভাঙচুর করেছে, এরপর বেশি বাড়াবাড়ি করলে ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাদের বাড়ি ঘর ভাঙচুর করা হবে। সে সব রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী বা পুলিশ যদি বিক্ষুব্ধ জনগণের উপর গুলি চালায়, সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিংহাসন কেঁপে উঠতে পারে। গুলি চালিয়ে তাদের বাড়িঘর রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়ার মত ভুল এ সরকার করবে না। শেখ হাসিনার উচিত ছিল ভারতে গিয়ে চুপ করে থাকা। তিনি যত উস্কানী দেবেন, এখানে আওয়ামী লীগের মিছিলকারীরা তত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবায়িত হবে না। তবে বাড়ি ঘর ভাঙচুরের ঘটনা যাতে আর না ঘটে সে দিকে অন্তর্বর্তী সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে। লেখক : গবেষক।